আফ্রিকার স্বঘোষিত সম্রাটের অভিষেক

উনিশশো সাতাত্তর সালে ডিসেম্বর মাস। মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের নতুন সম্রাট হিসেবে অভিষেক নিলেন জ্যঁ-বিডেল বোকাসা। সেই দিনটির কথা স্মরণ করছিলেন তার ছেলে জ্যঁ চার্লস বোকাসা এবং ফরাসি সাংবাদিক বার্নার্ড এডিংগার। খবর: বিবিসি বাংলা।

সম্রাট হিসেবে জ্যঁ-বিডেল বোকাসার অভিষেকের ওপর বিবিসি ১৯৭৭ সালে একটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছিল। জ্যঁ চার্লস বোকাসা বলছিলেন, ঐ অভিষেক ছিল খুবই ব্যতিক্রমী এক ঘটনা। সবাই এভাবে সম্রাট হতে পারে না বলে তিনি বলছিলেন।

সম্রাট বোকাসাকে ইতোমধ্যেই মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের আজীবন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। বোকাসা ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি ১৯৬৬ সালে এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সে দেশের ক্ষমতা দখল করেছিলেন। মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র আফ্রিকার সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি হলেও তার ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ছিল অঢেল।

চরম নৃশংসতা দেখানোর ব্যাপারে তার বেশ কুখ্যাতি ছিল। বলা হয়ে থাকে বন্দীদের মারপিটের সময় তিনি নিজে হাজির থাকতেন।

মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। কিন্তু তার পরও জ্যঁ-বিডেল বোকাসা ফরাসিদের সব কিছুই খুব পছন্দ করতেন।বিশেষভাবে তিনি ছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট চার্লস দ্য গলের দারুণ ভক্ত।

‘সম্রাট বোকাসার কাছে চার্লস দ্যা গল ছিলেন ভগবানের মতো,” বলছিলেন রয়টার্সের সাংবাদিক বার্নার্ড এডিংগার, “বলা হয়ে থাকে যে শুধুমাত্র জেনারেল দ্য গলের সাথে দেখা করার জন্য ফ্র্যাংকো-আফ্রিকান শীর্ষ সম্মেলনের সময় তিনি প্যারিস গিয়েছিলেন।’

‘সে সময় তিনি দ্য গলকে ‘পাপা’ (বাবা) বলে ডাকতেন। দ্য গল তাকে বলেছিলেন: ‘বোকাসা তুমি আমাকে পাপা বলে ডেক না।’ তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘উই পাপা (হ্যাঁ বাবা)।’

ক্ষমতা গ্রহণের আগে জ্যঁ-বিডেল বোকাসা ২০ বছরেরও বেশি সময় ফরাসি সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন। যদিও তিনি ছিলেন একটি স্বাধীন আফ্রিকান দেশের নেতা, কিন্তু ফ্রান্সের ব্যাপারে তিনি ছিলেন মোহগ্রস্ত। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ভ্যালেরি দঁস্ত্যাকে নিয়ে তিনি বাঘ-ভাল্লুক শিকারে যেতেন।তার অভিষেকের জন্য সব সামগ্রী তিনি ফ্রান্স থেকে আনানোর ব্যবস্থা করেছিলেন।

বার্নার্ড এডিংগার বলছিলেন, তিনি বিশাল একটা সিংহাসন এনেছিলেন। ফ্রান্সের নরম্যান্ডি থেকে এনেছিলেন ৪০টা ঘোড়া। ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন যে রকমটা ব্যবহার করতেন, তেমন ধরনের ঘোড়ার গাড়ি এনেছিলেন। সবুজ এবং সোনালি রঙের এই ঘোড়ার গাড়ির জন্য বহু অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল।

‘দুঃখজনক ব্যাপার হলো ঘোড়াগুলোর অনেকগুলোই মারা গিয়েছিল। কারণ ফরাসী ঘোড়া আফ্রিকার আবহাওয়া সহ্য করতে পারেনি।’

অভিষেক অনুষ্ঠানের ব্যয়ে কোন ধরনের কার্পণ্য করা হয়নি। ফ্রান্স থেকে ১৫ টন ফুল এবং পেটি বোঝাই করে শ্যাম্পেন আনা হয়েছিল। এক সাক্ষাৎকারে জ্যঁ-বিডেল খুব গর্ব করে তার মুকুটের হীরের টুকরোগুলো দেখিয়েছিলেন।

অভিষেকের দিন ঠিক করা হয় ৪ঠা ডিসেম্বর। আর অনুষ্ঠানের স্থান ঠিক করা হয়েছিল বোকাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি বোকাসা স্ট্রিটের ওপর বোকাসা স্টেডিয়ামে। সেই অনুষ্ঠানে পোপ আসতে না পারলেও তিনি বিশেষ বার্তা পাঠিয়েছিলেন। বোকাসাকে হাতে রাখার জন্য পশ্চিমা দেশগুলো থেকে শীর্ষ কর্তারা হাজির হয়েছিলেন। পুরো হল ঘরটি ছিল কানায় কানায় পূর্ণ।

সাংবাদিক বার্নার্ড এডিংগার বলছিলেন, ফরাসি দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রবার্ট গালিস রোমান সম্রাটের মতো কিম্ভুতকিমাকার পোশাক পরা বোকাসার প্রতি বার বার করে কুর্নিশ করছিল। পুরো ব্যাপারটা ছিল হাস্যকর।

‘কোন কারণে ঐ হলঘরে কোন এয়ারকন্ডিশনের ব্যবস্থা করা হয়নি। ঘরের মধ্যে ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড গরমে সবাই বসে দরদর করে ঘামছিল।’

সম্রাটের ছেলে জ্যঁ চার্লস বোকাসা বলছিলেন, পুরো বঙ্গি শহরের প্রায় সবাই সেই অভিষেক অনুষ্ঠান দেখতে হাজির হয়েছিলেন। গান বাজনার জন্য ফরাসি সেনাবাহিনীর অর্কেস্ট্রা দল উপস্থিত ছিল।

কোন রাষ্ট্রপ্রধান ঐ অভিষেক অনুষ্ঠানে হাজির না থাকলেও বেশ কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী, প্রধানত আফ্রিকার দেশগুলো থেকে, সেখানে অতিথি হয়ে এসেছিলেন।

জ্যঁ চার্লস বোকাসা বলছিলেন, স্টেডিয়ামে সম্রাট দেশের নতুন রাজকীয় সংবিধানের শপথ নিলেন। এরপর আমরা শোভাযাত্রা নিয়ে নটরডেম গির্জায় গেলা। দিনটা ছিল খুবই গরম।

‘ঘোড়াগুলোকে শান্ত রাখা কঠিন হয়ে পড়ছিল। চারটি ঘোড়া সেই দিনই মারা যায়। গির্জাটি খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছিল। পুরো অনুষ্ঠানটি ছিল রূপকথার মতো।’

কিন্তু এই রূপকথায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের অনুপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। আর তা হলো সাধারণ মানুষ, বলছিলেন সাংবাদিক বার্নার্ড এডিংগার।

‘দেশের সাধারণ নারী-পুরুষকে অভিষেক অনুষ্ঠান থেকে ১০০ গজ দূরে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছিল। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল তারা খুব আগ্রহ নিয়ে অনুষ্ঠান দেখতে এসেছিল। কিন্তু সৈন্যরা তাদের কাছে আসতে দিচ্ছিল না। কাছে আসার চেষ্টা করলেই সৈন্যরা কার্তুজের বেল্ট দিয়ে তাদের মারছিল।’

‘আমি যখন কাছে গিয়ে তাদের সাথে কথা বললাম তখন বুঝলাম ঐ অনুষ্ঠান আসার পেছনে তাদের অন্য আরেকটা কারণ ছিল। তারা ছিল ক্ষুধার্ত। তারা অনুষ্ঠানে রাখা খাবার দেখিয়ে বলছিল সেগুলো তারা খেতে চায়।’

যে দেশে বেশিরভাগ মানুষ দু’বেলা খেতে পায় না, সে দেশে এই ধরনের আড়ম্বর করে অভিষেক করা ছিল খুবই ব্যয়বহুল ব্যাপার।

এক হিসেব অনুযায়ী পুরো অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে কোটি কোটি ডলার ব্যয় হয়েছিল। দেশের বাজেটের একটা বড় অংশ এই কাজে খরচ করা হয়েছিল। এই ব্যয়ের একটা বড় অংশ এসেছিল ফ্রান্সের কাছ থেকে। কারণ শীতল যুদ্ধের সময় তাদের ঐ সাবেক উপনিবেশকে তারা ‘হাতে রাখতে’ চেয়েছিল।

সাংবাদিক বার্নার্ড এডিংগার বলছিলেন, বোকাসাকে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র বলে মনে করা হতো। কিন্তু তাকে একই সাথে একটা সঙ হিসেবেও দেখা হতো। কিন্তু সে ছিল নিজেদের পক্ষের সঙ। সে সময় পশ্চিম আফ্রিকার বহু ফরাসী-ভাষী দেশেই এই ধরনের নেতা ছিল। তেমনি ছিল পূর্ব আফ্রিকায়। যেমন ইদি আমিন।

কিন্তু সেই অভিষেকের এক বছরর মধ্যে ক্ষুধার্ত মানুষ মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে বিক্ষোভ শুরু করে। সরকার নিষ্পেষণের মধ্য দিয়ে এর জবাব দিতে থাকে। এর অবসান ঘটে যখন একদল শিশুকে হত্যা করা হয়।

এরা নতুন স্কুল ইউনিফর্মের প্রতিবাদ করছিল। সম্রাট বোকাসার স্ত্রী কোম্পানির তৈরি করা এসব ইউনিফর্ম কেনার সামর্থ্য তাদের ছিল না। তবে সম্রাট বোকাসা ঐ ঘটনার দায়দায়িত্ব অস্বীকার করেছিলেন।

ঐ ঘটনার পর ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফরাসি সেনাবাহিনী মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে অভিযান চালিয়ে সম্রাট বোকাসাকে উৎখাত করে এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডেভিড ড্যাকো-কে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনে। সম্রাট বোকাসা নির্বাসনে চলে গেলেও ১৯৮৬ সালে দেশে ফিরে আসেন। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্র্রদ্রোহ, খুন, অর্থ আত্মসাৎ, এমনকি নরমাংস ভক্ষণের অভিযোগে তার বিচার হয়। একমাত্র নরমাংস ভক্ষণ ছাড়া তিনি সব মামলায় দোষী প্রমাণিত হন।

আদালত প্রথমে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও পরে সেটা বদলে যাবজ্জীবন নির্জন কারাদণ্ড করা হয়। তবে ছয় বছর কারাবাসের পর ১৯৯৩ সালে তাকে মুক্তি দেয়া হয়। এর তিন বছর পর একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে জ্যঁ-বিডেল বোকাসার মৃত্যু হয়।

এসএইচ-১৮/১৮/১৯ (আন্তর্জাতিক ডেস্ক)