তাজমহলের তালাবদ্ধ ২২ কক্ষে যা আছে

তাজমহলের কথা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে চারকোণে চার সুউচ্চ মিনারবিশিষ্ট সুরম্য প্রাসাদোপম এক ভবন। কিন্তু এটা মূলত একটি রাজকীয় সমাধিসৌধ। যা ভারতের উত্তর প্রদেশে আগ্রায় যমুনা নদীরে তীরে অবস্থিত।

মুঘল সম্রাট শাহজাহান তার প্রিয়তম স্ত্রী আরজুমান্দ বানু বেগমের স্মৃতির উদ্দেশে অপূর্ব-অনন্যসাধারণ এই সৌধটি নির্মাণ করেন। আরজুমান্দ বানু বেগম তার ১৪তম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। তিনি মুমতাজ মহল নামেও পরিচিত ছিলেন। আর তার এ নামের সঙ্গে মিল রেখেই এর নাম হয় তাজমহল।

সৌধটির নির্মাণ শুরু হয় ১৬৩২ সালে। প্রায় ২২ বছর পর ১৬৫৩ সালে এর নির্মাণ সম্পন্ন হয়। তাজমহলকে মুঘল স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে দেখা হয়। সাদা মার্বেলের গম্বুজ আর দৃষ্টিনন্দন কারুকাজের জন্যই বেশি সমাদৃত রাজকীয় সমাধিটি। কিন্তু তাজমহল আসলে সামগ্রিকভাবে এক জটিল ও অখণ্ড স্থাপত্য।

বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি তাজমহল। ১৯৮৩ সালে একে বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান দেয় ইউনেস্কো। তখন একে ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের সর্বজন প্রশংসিত শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকর্ম’ বলে অভিহিত করা হয়। তাজমহল মানুষের আগ্রহের শেষ নেই।

এ নিয়ে প্রতিনিয়তই রচিত হচ্ছে প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা ও গান। সম্প্রতি তাজমহলের একটি বিষয় ফের আলোচনায় এসেছে। আর তা হচ্ছে, এর তালাবদ্ধ ২২টি কক্ষ। অনেকেরই প্রশ্ন, বন্ধ ওই ২২টি কক্ষের রহস্য কী। এর পেছনে আসলেই কী কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে।

এই প্রশ্ন থেকেই তাজমহলের ওই বন্ধ ২২টি কক্ষ খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে গত সপ্তাহে (০৭ মে) উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ হাইকোর্টে পিটিশন দায়ের করেন রজনীশ সিং নামে ভারতের ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এক সদস্য।

পিটিশনে রজনীশ বলেন, তাজমহলে ২২টি বন্ধ কক্ষের মধ্যে কী রহস্য লুকিয়ে আছে তা সামনে আসা উচিত। তিনি আরও বলেন, কিছু ইতিহাসবেত্তা ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের দাবি, তাজমহলের ওই কক্ষগুলোতে হিন্দু দেবতা শিবের মন্দির রয়েছে। তাদের এই দাবি সত্য কিনা সেটাই জানতে চান তিনি।

পাঁচদিন পর বৃহস্পতিবার (১২ মে) এক শুনানির পর পিটিশনটি খারিজ করে দেন আদালত। তাজমহলের তালাবন্ধ ‍ওই কক্ষগুলোর নেপথ্যে কোনো রহস্য নেই বলেই মনে করছেন বিচারকরা।

রজনীশকে উদ্দেশ্য করে আদারত বলেন, ‘এ বিষয়ে যে সর্বজন গৃহীত যে তথ্য রয়েছে, তা নিয়ে আপনি সন্তুষ্ট না হলে তা চ্যালেঞ্জ করতে পারেন। তবে সেক্ষেত্রে প্রথমে পড়াশোনা শুরু করুন। এমএ, পিএইচডি করুন। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেকে নথিভুক্ত করুন।’

রজশীং সিং তাজমহলের যে কক্ষগুলো খুলে দিতে বলেন, ওই কক্ষগুলো আসলে সৌধের নিচে (আন্ডারগ্রাউন্ড) অবস্থিত তথা ভূগর্ভস্থ কক্ষ। এবং সৌধের পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষ বা এ নিয়ে বিশদ গবেষণা করেছেন এমন ব্যক্তিদের বেশিরভাগেরই বক্তব্য, সেখানে তেমন কিছুই নেই।

মুঘল স্থাপত্যরীতির ওপর বিশেষ গবেষণা ও জ্ঞান রাখেনে এমন একজন ব্যক্তি এবা কচ। অস্ট্রিয়ার ইউনিভার্সিটি অভ ভিয়েনার এশিয়ান আর্ট বিভাগের অধ্যাপক তিনি। তাজমহল নিয়ে গবেষণা গ্রন্থও লিখেছেন তিনি। গবেষণার সময় তিনি তাজমহলের ওই বন্ধ ঘরগুলো ও সেগুলোর বারান্দাও প্রদর্শন করেছিলেন, ছবিও তুলেছিলেন।

কক্ষগুলো মূলত ছিল একটি ‘তাহখানা’র অংশ। মোগল স্থাপত্যরীতিতে তাহখানাগুলো তৈরি করা হত গ্রীষ্মকালে ঘর ঠাণ্ডা রাখার জন্য। যমুনা নদীর দিকে মুখ করে থাকা তাজমহলের একটি চত্বরে এরকম কয়েকটি সারিবদ্ধ কক্ষ রয়েছে। এবা কচ এ ধরনের ১৫টি কক্ষ খুঁজে পেয়েছিলেন।

তাজমহলে সাতটি বিশাল কক্ষ ছিল যেগুলো আবার দুপাশে কুলুঙ্গির মাধ্যমে বড় করা হয়েছিল। ছয়টি মোটামুটি বর্গাকৃতির কক্ষ এবং দুইটি অষ্টভুজাকৃতি কক্ষও ছিল। এ নিয়ে অধ্যাপক এবা কচ তার এক লেখায় বলেন, ‘সম্রাট, তার স্ত্রীরা, ও সমভিব্যাহারীরা যখন সমাধিটি ভ্রমণ করতেন, তখন এ ঘরগুলো নিশ্চয়ই বেশ আলোবাতাসপূর্ণ ছিল। এখন আর এগুলোতে প্রাকৃতিক কোনো আলো প্রবেশ করতে পারে না।’

মুঘল স্থাপত্যরীতিতে এরকম ভূগর্ভস্থ গ্যালারি প্রায়ই দেখতে পাওয়া যায়। পাকিস্তানের লাহোর শহরে অবস্থিত একটি মোগল দুর্গে জলাশয়মুখী এরকম অনেক কক্ষের সারি রয়েছে।

তাজমহলে ভ্রমণের ক্ষেত্রে শাহজাহান প্রায়ই যমুনা নদী দিয়ে নৌকায় চড়ে আসতেন। প্রশস্ত ঘাট পার হয়ে তিনি সমাধিস্থলে প্রবেশ করতেন।

এ নিয়ে অমিত বাগ নামে ভারতীয় গবেষক বলছেন, ‘তাজমহলে ঘুরতে গিয়ে ওই সুন্দর নকশাকাটা বারান্দাগুলো দেখার কথা আমার এখনো মনে আছে। সেই বারান্দা শেষ হয়েছে একটি বড় চত্বরের সামনে এসে। স্পষ্টই বোঝা যায় স্বয়ং সম্রাট এ বারান্দা ধরে হাঁটাচলা করতেন।’ এখন প্রায় ২০ বছর আগে তাজমহল ভ্রমণ করেছিলেন তিনি।

আগ্রায় জন্মগ্রহণকারী দিল্লিকেন্দ্রিক ইতিহাসবেত্তা রানা সাফভি’র তথ্য অনুযায়ী, তাজমহলের ভূগর্ভস্থ ওই কক্ষগুলো ১৯৭৮ সালের এক বন্যার আগপর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। ‘বন্যার পানি তাজমহলের ভেতরে ঢুকে যায়, অনেকগুলো পাতালঘর কাদামাটিতে ভরে যায়। এমনকি কোনো কোনোটাতে ফাটলও ধরে। এরপর থেকে কর্তৃপক্ষ সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য ওই ঘরগুলো বন্ধ করে দেয়। ওগুলোর ভেতরে কিছুই নেই,’ বলেন তিনি। এই ঘরগুলো সংস্কার কাজের জন্য সময়ে সময়ে খোলা হয়।

বিশ্বের অন্যসব আশ্চর্য বস্তুর মতো তাজমহল নিয়েও নানা মিথ আর কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। যেমন, অনেকে মনে করেন, শ্বেতপাথরের তাজমহলের বদলে শাহজাহান আসলে কালো তাজমহল তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তাজমহল কোনো এক ইউরোপীয় স্থপতির দ্বারা তৈরি হয়েছিল।

অনেক পশ্চিমা পণ্ডিত তর্ক করেছেন এই বলে যে, ভারতবর্ষের মুসলিম সমাজে নারীদের অবস্থান যে অধস্তন ছিল, তা-তে মনে হয় না কোনো নারীর জন্য এমন স্থাপনা কেউ তৈরি করবেন। অবশ্য ইসলামি বিশ্বে অন্যান্য নারীদের জন্যও যে সমাধিস্তম্ভ রয়েছে তা তারা ভুলে যান।

তাজমহল দেখতে আসা ভ্রমণপিয়াসীদের জন্য যারা পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেন তাদের মুখে প্রায়ই এমন মিথ শুনতে পাওয়া যায় যে, কাজ শেষ হওয়ার পর সম্রাট শাহজাহান স্থপতি ও নির্মাতাদের হত্যা করেছিলেন।

ভারতে তাজমহল সম্পর্কিত একটি দীর্ঘকালীন মিথ হলো এটি আদিতে একটি শিবমন্দির ছিল। ১৭৬১ সালে সরজ মাল নামের এক হিন্দু রাজা আগ্রা দখল করে নেওয়ার পরে তার সভার একজন পুরোহিত নাকি তাজমহলকে হিন্দু মন্দিরে পরিবর্তন করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। গবেষক পিএন ওক তার এক বইতে দাবি করেছেন, তাজমহল একটি শিবমন্দির ছিল।

২০১৭ সালে সংগীত সোম নামে বিজেপি’র একজন নেতা তাজমহলকে ভারতীয় সংস্কৃতির ওপর একটি ‘কলঙ্ক’ হিসেবে অভিহিত করেন। তার মতে এটি ‘বেইমানদের দ্বারা নির্মিত’ হয়েছিল।

চলতি সপ্তাহে দিয়া কুমারী নামে বিজেপির আরেকজন নেতা বলেন, শাহজাহান এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের ‘জমি দখল’ করে সেখানে তাজমহল বানিয়েছেন।

রানা সাফভি’র মতে, গত কয়েক দশকে ডানপন্থীদের একটি অংশের কাছে নতুন মাত্রা পেয়েছে এই ষড়যন্ত্রতত্ত্বগুলো। এবা কচের ভাষায়, তাজমহলকে নিয়ে গবেষণাধর্মী লেখার চেয়ে গল্পগাছাই বেশি হয়েছে।

এসএইচ-১৪/১৩/২২ (আন্তর্জাতিক ডেস্ক)