পুতিন একাই একশ!

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে টানা চার বছর (২০১৩ থেকে ২০১৬) বিশ্বের শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে বেছে নিয়েছিল ফোর্বস ম্যাগাজিন। এ ছাড়া ২০১৮ ও ২০২০ সালে ফোর্বসের তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন তিনি।

২০১৮ সালে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন পুতিনকে বিশ্বের যে কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির চেয়ে শক্তিশালী হিসেবে চিহ্নিত করে। নিজ দেশে প্রভাব বিস্তার ও তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে পুতিন মার্কিন ম্যাগাজিন ফোর্বসের তালিকায় উঠে আসেন। পুতিনের বৈশ্বিক প্রভাব মূলত এর তেল ও গ্যাসের কারণে। রুশ কোম্পানি গ্যাজপ্রম ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জ্বালানির বড় জোগানদাতা।

কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের পর পুতিনের সেই প্রভাব প্রতিপত্তি লোপ পেয়েছে মার্কিন সাময়িকী টাইমের তালিকায়। চলতি বছর শীর্ষ ১০ নেতার মধ্যে শেষদিকে অবস্থান দেখানো হয়েছে পুতিনের। তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি আর নবম স্থানে পুতিন। প্রশ্ন হলো, পুতিন আসলে কতটা ক্ষমতাধর? ইউক্রেন যুদ্ধে দেশটি আসলে শক্তি বলে জয়ের দিকে যাচ্ছে নাকি ভাগ্যই তাকে জয়ের দিকে ঠেলে দেবে? পুতিনের ভাগ্য, শক্তি ও বিচক্ষণতার জন্য চূড়ান্ত পরীক্ষা হিসেবে দেখা দিয়েছে ইউক্রেনের যুদ্ধমঞ্চ।

রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের বিপুল মজুত রয়েছে। দেশটিকে বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিধর বাহিনী মনে করা হয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে দেশটি ‘পারমাণবিক পরাশক্তির’ মর্যাদাও পেয়েছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর দেখে মনে হচ্ছে, পুতিন ও রুশ বাহিনীর চেয়ে জেলেনস্কি ও ইউক্রেনীয় বাহিনী বেশি শক্তিশালী। এ যুদ্ধে ইউক্রেনীয়রাই জয়ী হবে। প্রতিরোধের মুখে রাশিয়া কিয়েভ দখলের পরিকল্পনা থেকে পিছু হটেছে।

কিন্তু যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, রাশিয়া কিয়েভ দখলের হয়তো পরিকল্পনাই করেনি। মস্কোর মূল লক্ষ্য, ইউক্রেনীয় জ্বালানিসমৃদ্ধ পূর্বাঞ্চল দখল করা। ইউক্রেন যুদ্ধের একশ দিনের মধ্যে রুশ বাহিনী লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, মারিউপোল হয়ে খেরসন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। বর্তমানে তারা সেভেরোদোনেৎস্ক শহর দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে রাশিয়ার দিকে তাকালে দেখা যাবে, রাশিয়া এ যুদ্ধে এগিয়ে আছে। ইউক্রেনের কৃষ্ণসাগরীয় বন্দর ওদেসা দখল নিতে পারলেই রাশিয়ার উদ্দেশ্য অনেকটাই হাসিল হবে। ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চল (মারিউপোল থেকে ওদেসা) যদি রাশিয়া দখলে নেয় তাহলে কৃষ্ণসাগরে ইউক্রেনের আর কোনো দখলদারিত্ব থাকবে না। ফলে ন্যাটোও আর ইউক্রেনের দিকে চোখ দেবে না। ন্যাটোর লোভাতুর দৃষ্টি ছিল, ইউক্রেনের কৃষ্ণসাগরে প্রভাব বিস্তার করা।

রাশিয়ার যুদ্ধ মূলত পশ্চিমের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ। রাশিয়া কখনোই চায়নি, তার সীমান্তবর্তী দেশগুলো ন্যাটোর সদস্য হোক। কিন্তু পোল্যান্ড ও বাল্টিক দেশকে (ইস্তোনিয়া, লাতভিয়া ও লিথুয়ানিয়া) ন্যাটোর সদস্য করা হয়েছে। এসব দেশের ন্যাটোভুক্তি নিয়ে রাশিয়ার কোনো অসন্তোষ আমলে নেয়নি মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটটি। রাশিয়ার উদ্দেশ্য হাসিল হলেই তারা নিজেই ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিতে পারে। চীন, ইরান, তুরস্ক এমনকী ভারতের সমর্থন নিয়ে ইউক্রেন-রাশিয়ার শান্তিচুক্তি হতে পারে।

অন্যদিকে রাশিয়াকে ঘায়েল করতে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে উল্টো বিপদে পড়েছে পশ্চিমারাই। নিষেধাজ্ঞার আগের তুলনায় রাশিয়ার অর্থনীতি গতিশীল রয়েছে। তেল ও গ্যাসের দাম বাড়ার ফলে জ্বালানিসমৃদ্ধ রাশিয়ার র‌ফতানি রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাব মতে, যুদ্ধের আগের তুলনায় রাশিয়ার যে বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল, এখন তার তিনগুণ বেশি অর্থ জমা হয়েছে। শুধু তাই নয়, রুশ মুদ্রা রুবলের মান বেড়েছে। অন্যান্য দেশের মুদ্রার চেয়ে রুবল এখন অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে।

এ ছাড়া পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপে গ্যাস বিক্রি বন্ধের হুমকি দিয়েছিল রাশিয়া। যেসব ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার কাছে গ্যাস কিনবে না বলে স্থির হয়েছিল তারাও এখন রাশিয়ার কাছে ধরনা দিচ্ছে। সুযোগে রাশিয়া তাদের রুশ মুদ্রা রুবলের বিনিময়ে জ্বালানি কিনতে বাধ্য করছে। ফলে মার্কিন ‘পেড্রো-ডলার’ সিস্টেম হুমকিতে পড়েছে।

নিষেধাজ্ঞায় বিচ্ছিন্ন হওয়া পুতিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ রয়েছে। এখন পর্যন্ত এ যুদ্ধে অটল তিনি। বার বার স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এ অভিযান থেকে সরে দাঁড়াবেন না তিনি। এর জন্য যত কঠোর হওয়ার তিনি হবেন। পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতে, তিনি এ যুদ্ধে আশানুরূপ সাফল্য পাননি। তবে রুশ বাহিনীর লেগে থাকা ও যেসব অঞ্চল তারা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, তা কম নয়।

এসএইচ-১৭/১৪/২২ (আন্তর্জাতিক ডেস্ক)