ভারতীয় গণতন্ত্রের ৭৫ বছর, হতাশা ও শঙ্কায় মুসলমানরা

ভারত যখন স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদ্‌যাপন করছে, তখন দেশটির মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুরা নিজেদের অবরুদ্ধ অবস্থায় আবিষ্কার করছেন। ২০১৪ সাল থেকে ভারত শাসন করছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অধীন ভারত ক্রমাগত ডানপন্থার দিকে এগোচ্ছে। প্রকাশ্যে ও সুসংগঠিতভাবেই হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠবাদী এজেন্ডাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। তা মুসলমানদের হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছে। সামাজিকভাবে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন।

কাতারের সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরায় এ নিয়ে বিশ্লেষণ লিখেছেন দিল্লিভিত্তিক সাংবাদিক বলয় সিং। মোদি সরকারের অধীন মুসলমানরা যে ক্রমে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন ও বয়কটের শিকার হচ্ছেন, তার এ প্রতিবেদনে তা-ই উঠে এসেছে।

সমালোচকরা বলছেন, মোদির অধীন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ কার্যত রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হয়েছে। দেশকে ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ ঘোষণা করতে সংখ্যাগরিষ্ঠদের দাবি দিন দিন জোরদার হচ্ছে।

দেশজুড়ে মুসলমানেরা স্থূল ও সূক্ষ্ম বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। মোদির বিজেপি সমর্থিত ডানপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠী, রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো মুসলমানদের বিরুদ্ধে অব্যাহত বৈষম্য করে যাচ্ছে। মুসলমানদের পোশাক, ইবাদতের জায়গা, ধর্ম প্রচার ও চর্চার সাংবিধানিক অধিকার—সব কিছুতে হামলা চলছে, নিষিদ্ধ করা হচ্ছে, গুঁড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। মুসলমানদের অধিকারগুলো ছোট হয়ে আসছে। ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই মুসলমানদের ওপর খড়গ নেমে এসেছে।

ভারতের ইতিহাসে প্রথম পার্লামেন্টে ক্ষমতাসীন দলের কোনো মুসলিম প্রতিনিধি নেই। লেখক ও সাংবাদিক ধীরেন্দ্র কে ঝা বলেন, যদি হিন্দু রাষ্ট্রের মানে এই দাঁড়ায় যে, মুসলমানরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, তাহলে এরইমধ্যে ভারতে তা কার্যকর হয়ে গেছে। এখানে মুসলমানরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক।

সংখ্যাগরিষ্ঠ আইন

পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তগুলো সমানে ভারত রাষ্ট্রের ধরনে পরিবর্তনের আভাস দিচ্ছে। ২০১৮ সালে তিন তালাক বাতিল করে একটি আইন পাস করে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এরইমধ্যে বিজেপিশাসিত বিভিন্ন রাজ্যে ‘লাভ জিহাদ’ আইন পাস করা হয়েছে। এতে বিয়ের মধ্য দিয়ে ধর্মান্তকরণকে অপরাধ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

২০১৯ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাস করে মোদি সরকার। এতে প্রতিবেশী দেশগুলোর অমুসলিম সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেয়ার অনুমোদন দেয়া হয়। এসব আইন পাসের ঘটনায় নজিরবিহীন বিক্ষোভ হয়েছে। এমনকি রাজধানী নয়াদিল্লিতে দাঙ্গায় অন্তত ৫৩ জন নিহত হয়েছেন।

দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্ণাটকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ করেছে সেখানকার বিজেপি সরকার। ২০২১ সালে মাদরাসা বিলুপ্ত করে আইন পাস করেছে উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম।

গত সপ্তাহে মোদির আসন বারণসীতে ‘হিন্দু রাষ্ট্রের’ ৩২ পাতার খসড়া সংবিধান প্রকাশ করা হয়েছে। ডানপন্থী হিন্দু সংগঠনগুলোর এই সংবিধানে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের ভোটাধিকার অস্বীকার করা হয়েছে।

অ্যাকটিভিস্ট খালিক খান বলেন, হিন্দু রাষ্ট্র নিয়ে যে কথা উঠেছে, তা কেবল অন্যায় ও নৃশংসতার ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা হতে পারে। যাতে মুসলমানসহ অহিন্দুদের অস্বীকার করা হবে।

হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের ভিত্তি ভূমি অযোধ্যার জোড়া শহর ফাইজাবাদে বসবাস খালিক খানের। তিনি বলেন, মুসলমানদের ক্ষমতাশূন্য ও মনোবল নষ্ট করে দেয়া এবং সামাজিকভাবে হীন করতেই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

১৯৯০-এর দশকে ধর্মীয় আন্দোলনের ফলে বিজেপির জনপ্রিয়তা বাড়ে। ওই আন্দোলনের কারণে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে মেরুকরণ ঘটে। মুসলমানদের হানাদার ও বহিরাগত হিসেবে আাখ্যায়িত করা হয়।

১৯৯২ সালে উত্তরপ্রদেশের বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে দিতে হিন্দু জনতাকে অনুমতি দেয় তখনকার বিজেপি সরকার। অযোধ্যায় ষোড়শ শতকের ওই অবকাঠামো ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়। কারণ তাদের বিশ্বাস—মসজিদটি এমন জায়গায় নির্মিত, যেখানে হিন্দু দেবতা রামের জন্ম হয়েছিল।

২০১৯ সালে বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণের অনুমতি দেয় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। যদিও মসজিদের আগে সেখানে কোনো মন্দির থাকার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সেখান থেকে ১৬ মাইল দূরে মসজিদ নির্মাণে মুসলমানদেরও একটি জমি দেয়া হয়।

আদালতের রায়ের মাসছয়েক পর হিন্দু ধর্মানুষ্ঠানের মাধ্যমে মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন মোদি। তখন ভারতের সরকারি ও বেসরকারি সম্প্রচার মাধ্যমগুলোতে তা সরাসরি প্রচার করা হয়। এরপর আরও তিনটি বছর চলে গেলেও মসজিদ নির্মাণের কোনো খবর নেই। সরকারি লাল ফিতায় আটকে আছে মসজিদ নির্মাণের অনুমোদন।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শেষ হওয়ার পর ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যায় উপমহাদেশ। ভারতে হিন্দু সংখ্যাগরু আর পাকিস্তানে মুসলমান। তাড়াহুড়ো করা সীমান্ত রেখা টেনে দেয়ার পর দেশভাগের সময় প্রায় ২০ লাখ মানুষ নিহত হন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাস্তুচ্যুত হন দেড় কোটি।

মহাত্মা গান্ধী ও প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর অধীন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের বাতিঘর হিসেবে ভারতের জন্ম হয়। একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র—যেখানে সব মত, পথ ও ধর্মের মানুষের সমান স্বাধীনতার কথা বলা হয়।

ভারত স্বাধীন হওয়ার চার মাস পর ১৯৪৮ সালের শুরুর দিকে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা হয়। হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদে বিশ্বাসী এক গুপ্তঘাতক তাকে হত্যা করে। অবিভক্ত ভারতকে ব্যবচ্ছেদের জন্য গান্ধী ও নেহরুর কংগ্রেস দলকে দায়ী করে আসছে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা।

রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) রাজনৈতিক শাখা বিজেপি। ইউরোপীয় নাৎসিবাদের অনুসরণে ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আরএসএস। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় উগ্র-ডানপন্থী এই আধাসামরিক সংস্থাটি। এটির লাখ-লাখ আজীবন সদস্য রয়েছে।

বিজেপির আদর্শিক ভিত্তি আরএসএস। এছাড়াও দেশ ও দেশের বাইরে আরও কয়েক ডজন হিন্দু ডানপন্থি গোষ্ঠী আছে। তারা ‘এক দেশ, এক জাতি, এক সংস্কৃতির’ ধারণায় বিশ্বাস করে। গত সপ্তাহে সংগঠনের মুখপত্রে আরএসএসপ্রধান মোহন ভগবত লিখেছেন, একই মাটির সন্তান হিসেবে পরস্পরের মধ্যে সাদৃশ্য বুঝতে পারা, ভিন্নমতকে সম্মান দেয়া, স্বার্থপরতা থেকে বেরিয়ে আসা, বৈষম্য এড়িয়ে চলা এবং সবার আগে দেশ—বর্তমান সময়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে এসব মাথায় রাখতে হবে।

মুসলমানদের নিয়ে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন ২০ শতকের শুরুর দিকে আরএসএস মতাদর্শের প্রবক্তা বিনায়ক দামোদর সাভারকর। তিনি বলেন, যদিও মুসলমানদের পিতৃভূমি হিন্দুস্থান, তবুও এটা তাদের পবিত্রভূমি না। তাদের পবিত্রভূমি সুদূর আরব ও ফিলিস্তিনে।

এ নিয়ে আরএসএসের এক মুখপাত্রের বক্তব্য চাইলে আল-জাজিরার সঙ্গে তিনি কথা বলতে অস্বীকার করেন।

স্বপ্নের ওপর আঘাত

মোদির ভারতে মুসলমানদের নিয়মিত পরীক্ষার মধ্যে পড়তে হচ্ছে। তাদেরকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বর্জন করা হচ্ছে। গেল ৭৫ বছরে ভারতে ঘুড়ি উড়িয়ে ১৫ আগস্ট উদ্‌যাপন করা হতো। যা ছিল ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সূক্ষ্ম প্রতীক। কিন্তু এ বছরে ‘হর ঘর তেরঙ্গা’ প্রচারের মাধ্যমে ভারতে স্বাধীনতা দিবস উদ্‌যাপন করা হয়। হর ঘর তেরঙ্গা বলতে দেশের প্রতিটি ভবন ও বাড়িতে পতাকা উত্তোলনের কথা বলা হয়েছে।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মুখপাত্র শারদ শর্মা বলেন, আমরা মনে করি, যারা হর ঘর তেরঙ্গা কর্মসূচিতে অংশ নেবে না, তারা দেশবিরোধী। তারা হলো তাদেরই প্রেতাত্মা, যারা ভারত ভাঙতে চায়। তাদের জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা উচিত।

তিনি আরও বলেন, কারও ভয় পাওয়া উচিত না। যারা ভীত, তাদের ওপর সম্ভবত পাকিস্তান ও রোমের প্রভাব পড়েছে। আমি মনে করি না, ভারতে কোনো ভয় আছে।

কিন্তু ভারতীয় কবি ও শিক্ষাবিদ সাবিকা আব্বাস নকভী বলেন, এখানে মুসলমানদের ভয় পাওয়ার বহু কারণ আছে। হিন্দু রাষ্ট্রের সঙ্গে ভয়ের সংমিশ্রণ আছে। আমার মনে হচ্ছে, আমরা সবাই মিলে যে স্বপ্নকে গড়ে তুলেছিলাম, তার ওপর আঘাত হলো এই হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা।

তিনি আরও বলেন, একজন মুসলমান নারী হিসেবে আমার পরিচয় ঝুঁকিতে। আমাদের দণ্ডিত মরদেহ, আমাদের জীবন ও স্বপ্নের ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন ভারত গড়ে তোলা হচ্ছে। আমাদের শঙ্কা—আমরা এমন একটি জাতি থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছি, যেখানে সাংবিধানিকভাবে আমাদের একীভূত করা হয়েছিল।

সম্প্রতি ভারতের জাতীয় প্রতীকের একটি আগ্রাসী সংস্করণ উন্মুক্ত করেছেন নরেন্দ্র মোদি। নির্মাণাধীন নতুন পার্লামেন্ট ভবনের ওপর একটি হিংস্র সিংহের গর্জনের এই ভাস্কর্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেরও খবর হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় ভাস্কর্যের সঙ্গে মিল রেখে এই প্রতীক নির্মাণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সমালোচকরা দাবি করেন, প্রাচীণ ভাস্কর্যের চেয়ে এই সিংহের মূর্তি আরও হিংস্র হিসেবে দেখানো হয়েছে।

চলচ্চিত্র পরিচালক সাঈদ মির্জা বলেন, বড় পরিসরে দেখলে, জাতভিত্তিক পার্থক্য ও ব্রাহ্মণীয় আধিপত্যের দৃষ্টিভঙ্গিকে হিন্দুজাতীয়তাবাদের মুখোশে আড়াল করে দেয়া হয়েছে।

জাতীয় প্রতীকের এই রূপান্তরকে সহনশীল লোকাচার ও বহুত্ববাদ থেকে উগ্র ও ঘৃণায়পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠবাদের প্রতিফলন হিসেবে দেখছেন ভারতীয়দের অনেকেই।

হায়দারাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক তানভীর ফজল বলেন, এখানকার মুসলমানরা একই জাতীয় না, কিন্তু ক্রমবর্ধমান বৈষম্য ও নির্যাতনের মুখে তারা ঐক্যবদ্ধ। সর্বত্রই তাদের প্রথম উদ্বেগ হলো, জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা। আর গরিব মুসলমানরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।

তিনি বলেন, ভারতীয়রা যদি এই ধর্মীয় মেরুকরণ বন্ধ না করে, তবে অদূর ভবিষ্যতে মুসলমনরা অবরুদ্ধ অবস্থায় থেকে যাবেন।

এসএইচ-২৭/১৫/২২ (আন্তর্জাতিক ডেস্ক)