পানি সংকট নিরসনে ভারতে অভিনব প্রযুক্তি

ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ের ব্যস্ত সড়কগুলো থেকে ১২০ মাইল দূরে কেরাওয়াদি গ্রাম। সেখানেই বাস করেন ছায়া বিদূষী। গ্রামটির বাসিন্দাদের জীবন-যাপন পুরো পৃথিবী থেকে ভিন্ন। নদী থেকে পানি আনতে দিনের চার ঘণ্টা চলে যায় ছায়া বিদূষী কিংবা অন্য নারীদের। রোজ দুবার নদীতে যান তারা—সন্ধ্যা ৬টা ও বিকাল ৪টায়।

ছায়া বিদূষী বলেন, গ্রীষ্মে গরমের তেজ বেশি। পানি আনতে গিয়ে আমাদের অনেকে মূর্ছা যান। আমার নিয়মিত মাথা ও পিঠব্যথা রয়েছে। পানি আনতে গিয়ে আমার হাত ব্যথা হয়ে যায়। আর বয়স্কদের জন্য তা আরও মুশকিলের। পানির জন্য আমার ষাটোর্ধ্ব শাশুড়িকেও মারাত্মক কষ্ট করতে হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে তিনি আমার সঙ্গে পানি আনতে যান।

পানি সংকটের কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা পরোক্ষভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এভাবে পানি টেনে জীবন ক্ষয় করতে চাচ্ছেন না তরুণীরা। তারা ক্লান্তিবোধ করছেন। যে কারণে গ্রামের কাউকে বিয়ে করতেও তারা অনাগ্রহী। ফলে বিয়ের পাত্রী খুঁজে পাচ্ছেন না পুরুষরা।

ছায়া বিদূষী বলেন, আমাদের গ্রামে বহু পুরুষ আছেন, যারা বিয়ে করতে পারছেন না। এর জন্য দায়ী কেবল পানি সংকট।

সরকারি হিসাব বলছে, গ্রামীণ ভারতে এমন ঘটনাই এখন অহরহ। সম্প্রতি কিছুটা অগ্রগতি ঘটলেও প্রায় অর্ধেকের মতো বসতবাড়িতে পানির অভাব রয়েছে।

পানি সংকটের প্রভাব কেবল বসতবাড়িতেই পড়ছে না, কৃষিক্ষেত ও শিল্প-কারখানায় পর্যাপ্ত পানি নিশ্চিত করাও বড় চ্যালেঞ্জ। বৈশ্বিক জনসংখ্যার সতেরো শতাংশের বাস ভারতে। কিন্তু বিশ্বের মোট মিঠাপানির চার শতাংশের উৎস দেশটিতে।

এ গ্রহের পানি দুষ্পাপ্য দেশগুলোর একটি ভারত। এতে সেখানকার ভবিষ্যৎ খাদ্য উৎপাদন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ পানির সংকটে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

জননীতি বিষয়ক থিংকট্যাংক এনআইটিআই আয়োগের ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, গম চাষের ৭৪ শতাংশ ও ধান চাষের ৬৫ শতাংশ এলাকায় ২০৩০ সাল নাগাদ পানিস্বল্পতা মারাত্মক আকার নিতে যাচ্ছে।

বর্ষা আসলে পানি-বরাদ্দ পরিকল্পনা করা কঠিন হয়ে যায়। বার্ষিক বৃষ্টিপাতের ৮০ শতাংশ ঘটে জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে। একটানা ২৫ দিনও ভারী বৃষ্টি হতে পারে এসব মাসে।

প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের সময়ে দেশের এক-সপ্তমাংশে বন্যার শঙ্কা দেখা দেয়। পানি সংকট নিয়ে এনআইটিআই আয়োগকে পরামর্শ দেয়া অভিনাস মিসরা বলেন, ভারতে পানির উৎসগুলো সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে না। যে কারণে এই সংকট চলছে।

তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন নদী-নালা-খাল ও বিলে অপরিশোধিত পানি ফেলে দেয়া হচ্ছে। এতে দূষণ ক্রমে বাড়ছে।

এদিকে ভারতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা অতিরিক্ত মাত্রায় বাড়ছে। এতে মাটির নিচের পানির স্তর আরও পড়ে যাচ্ছে। অভিনাস মিসরা বলেন, ভূগর্ভ থেকে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি, রাজস্থান ও কর্নাটকে যতটা পানি তোলা হচ্ছে, ততটা পূর্ণ হচ্ছে না। অর্থাৎ মাটির নিচ থেকে যে মাত্রায় পানি তোলা হয়, সেই অনুসারে সেখানে পানি ভরাট হচ্ছে না।

ভালো উপাত্ত সংগ্রহের মাধ্যমে এ সমস্যার একটা সমাধান বের করা যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। জাতীয় জলবিজ্ঞান প্রকল্প (এনএইচপি) বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কাজ করছে ভারতের জলশক্তি মন্ত্রণালয়।

১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝিতে এ রকম দুটি পরিকল্পনা ছিল। এখন তৃতীয় প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্যে রয়েছে সরকার। আগামী ২০২৪ সালের মার্চে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা রয়েছে।

প্রথম দুটি পরিকল্পনায় পানি পরিমাপের ব্যবস্থা স্থাপন ও ভারতের পানির উৎস নিয়ে উপাত্ত জড়ো করা হয়েছে। কিন্তু জলশক্তি বোর্ডের যুগ্ম সচিব সুবোধ যাদব বলেন, এসব প্রকল্পের অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। অধিকাংশ তথ্য ব্যক্তি পর্যায়ে সংগ্রহ করা হয়েছে এবং কার্যকরভাবে তা কাজে লাগানো হয়নি। কিন্তু এরইমধ্যে লোকজনের হাত থেকে সেসব তথ্য উধাও হয়ে গেছে।

তিনি আরও বলেন, স্বতন্ত্র সরকারি বিভাগগুলো এসব তথ্য বিশ্লেষণ করলেও কার্যকরভাবে তা উপস্থাপন করতে পারেনি। তবে সেই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে সাম্প্রতিক জলবিজ্ঞান প্রকল্পে।

এরইমধ্যে ভারতের বিভিন্ন লেক, নদী ও জলাধারগুলোতে ছয় হাজার সেনসর বসানো হয়েছে। আর ভূগর্ভস্থ পানি শনাক্ত করতে বসিয়েছে আরও এক হাজার ৬০০ সেনসর। আর সবগুলোর সঙ্গে মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কের সংযোগ করে দেয়া হয়েছে, যাতে পানির স্তর, আবহাওয়ার অবস্থা, আর্দ্রতা, বায়ুর চাপ ও বৃষ্টিপাত নিয়ে রিয়েল-টাইম উপাত্ত পাঠাতে পারে।

একটি কেন্দ্রীয় ওয়েবভিত্তিক ব্যবস্থায় এসব উপাত্ত জমা থাকবে। যে কেউ ইচ্ছা করলে তা ব্যবহার করতে পারবে। এ সংক্রান্ত সফটওয়্যার তৈরি করা হচ্ছে। সেনসর থেকে পাওয়া উপাত্ত বিশ্লেষণ করতে পারবে এই সফটওয়্যার। এতে করে নীতিরির্ধারকেরা সহজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে পানি সংকট নিরসনে ভারতীয় সরকার প্রযুক্তিনির্ভর কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে।

সুবোধ যাদব বলেন, অভিজ্ঞতা ও বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে বর্তমানে সিদ্ধান্ত নেয়ার যে প্রবণতা রয়েছে, তা থেকে সরে আসার চেষ্টা করছে সরকার। বাস্তবিক তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে পানি ব্যবস্থাপনার উন্নতি করার চেষ্টা চলছে। এ ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় সেনসরের মাধ্যমে পাওয়া উপাত্ত ও আধুনিক বিশ্লেষণী হাতিয়ারের ওপর নির্ভর করতে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

পানি সংরক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহে প্রযুক্তিনির্ভর এসব জাতীয় প্রকল্পের অধিকাংশ কাজ শেষ হয়েছে। শিগগিরই তার ফল পেতে শুরু করবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।

মহারাষ্ট্রের প্যাকভাদ গ্রামের মেঘা দোম্বি। পরিবারের জন্য পানি আনতে তাকে দিনে ছয় ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় করতে হতো। তিনি বলেন, এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের কোনো নিশ্চয়তা নেই। এখানে বৃষ্টি একেবারে অনিয়মিত। মায়েদের জন্য দুঃস্বপ্ন নিয়ে আসে পানি সংকট।

এসএইচ-০৯/১৮/২২ (আন্তর্জাতিক ডেস্ক)