মিয়ানমার সেনাদের যুদ্ধে অস্বীকৃতি, পালাচ্ছেন বাহিনী থেকে

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ছেড়ে লোকজন চলে যাচ্ছে এবং এই বাহিনীর জন্য নতুন সৈন্য নিয়োগ দেওয়াও কঠিন হয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনী ত্যাগ করে চলে আসা সৈন্যরা বিবিসিকে বলছেন দু’বছর আগে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেওয়া সামরিক জান্তা বর্তমানে গণতন্ত্রপন্থী সশস্ত্র আন্দোলন দমন করতে হিমশিম খাচ্ছে।

“কেউ সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে চায় না। তাদের নিষ্ঠুরতা এবং অন্যায় কর্মকাণ্ডকে লোকেরা ঘৃণা করে,” বলেন নে অং। প্রথমবার তিনি যখন তার ঘাঁটি থেকে পালানোর চেষ্টা করেন, সেসময় তাকে রাইফেলের বাট দিয়ে মারাত্মকভাবে পেটানো হয়। তাকে বলা হয় “বিশ্বাসঘাতক।”

দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং বিরোধী গ্রুপগুলোর সহযোগিতায় সীমান্ত পার হয়ে চলে যান থাইল্যান্ডে।

“প্রতিরোধ বাহিনীতে আমার একজন বন্ধু আছে। আমি তাকে ফোন করলাম এবং সে থাইল্যান্ডের লোকজনকে আমার কথা বলল। তাদের সাহায্য নিয়ে আমি এখানে এসে পৌঁছাই,” বলেন তিনি।

এখন সে আরো ১০০ জন সৈন্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে গোপন একটি বাড়িতে থাকে যারা সম্প্রতি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ছেড়ে পালিয়ে এসেছে।

এই সৈন্যরা, যারা তাদের নিজেদের দেশের লোকজনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, তারা আত্মগোপন করে আছে। একারণে তাদের আসল নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।

মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে যারা প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছে তারাই তাদেরকে আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিচ্ছে।

নির্বাসিত জাতীয় ঐক্যের সরকারের দেওয়া তথ্য অনুসারে সামরিক বাহিনী ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার পর থেকে ১৩ হাজার সৈন্য ও পুলিশ তাদের বাহিনী ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

আরো সৈন্য ও পুলিশ কর্মকর্তা যাতে পক্ষ বদল করে সেজন্য নির্বাসিত সরকার নগদ অর্থ এবং আরো কিছু সুযোগ সুবিধা দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

থাইল্যান্ডের নিরাপদ আশ্রয়ে যারা অবস্থান করছে তাদের একজন ১৯ বছর বয়সী মং সেইন। সেখানে তিনি সর্বকনিষ্ঠ। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন।

“আমি সামরিক বাহিনীর ভক্ত ছিলাম,” বলেন মং সেইন। তিনি ভেবেছিলেন এই বাহিনীতে যোগ দিলে তার পরিবার গর্বিত হবে। তবে গণতন্ত্রকামী আন্দোলন দমনে সেনাবাহিনী যেভাবে সহিংস হয়ে উঠল, তাতে সৈন্যদের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি নাটকীয়ভাবে বদলে গেল।

“অনলাইনে দেখলাম লোকজন আমাদের ‘সামরিক কুকুর’ বলছে,” বলেন তিনি। মিয়ানমারে কাউকে এই প্রাণীর নাম ধরে ডাকা অপমানজনক। “এতে আমার খুব খারাপ লাগল।”

মং সেইন বলেন, “উপরের মহল থেকে বেসামরিক লোকজনকে হত্যা ও গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার যে নির্দেশ দেওয়া হতো” তার মতো একজন সৈন্যের সেসব অমান্য করার কোনো উপায় ছিল না।

তিনি মনে করেন সামরিক বাহিনীর অবস্থান এখন দুর্বল এবং তিনি যে সেখান থেকে চলে এসেছেন এটাও তার একটা কারণ।

মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় বিভিন্ন বেসামরিক মিলিশিয়া গ্রুপের নেটওয়ার্ক পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস বা পিডিএফের পাশাপাশি আরো যেসব জাতিগত সশস্ত্র গ্রুপ সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করছে, সেগুলোও এখন অনেক বেশি শক্তিশালী বাহিনী হয়ে ওঠেছে এবং মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী দেশের অনেক জায়গাতেই তাদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে।

একসময় যে মাগওয়ে এবং সাগাইং এলাকা থেকে প্রচুর লোকজনকে সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ করা হতো, সেখানকার তরুণরা এখন সামরিক বাহিনীর পরিবর্তে বেসামরিক মিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দিচ্ছে।

সামরিক বাহিনী থেকে মং সেইনের পালিয়ে আসার আগে তার ইউনিটকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল পিডিএফের একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে “হামলা চালিয়ে ধ্বংস” করে দেওয়ার জন্য।

পিডিএফের প্রতি লোকজনের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে এবং গ্রামবাসীরা সামরিক বাহিনীর চলাচলের ব্যাপারে তাদেরকে গোপনে তথ্য সরবরাহ করে। এছাড়াও গ্রামবাসীরা তরুণ মিলিশিয়া যোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়ে থাকে।

ক্যাপ্টেন জে থু অং ১৮ বছর বিমান বাহিনীতে চাকরি করেছেন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সামরিক অভ্যুত্থানের এক বছর পরেই তিনি এই বাহিনী থেকে পালিয়ে যান।

“সারা দেশেই তাদের ওপর আক্রমণ চলছে,” বলেন তিনি। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বর্তমান অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, “তাদের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট সৈন্যও তাদের নেই।”

তিনি বলেন একারণেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী এখন বিমান বাহিনীকে খুব বেশি ব্যবহার করছে।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সামরিক বাহিনী সারা দেশে বড় ধরনের বিমান হামলা চালিয়েছে। জানা গেছে এবছরের জানুয়ারি মাসের পর থেকে দুশোর বেশি বিমান হামলা চালানো হয়েছে। সবচেয়ে বড় হামলাটি চালানো হয়েছে এপ্রিল মাসে সাগাইং অঞ্চলের পা জি গি গ্রামে যাতে ১৭০ জনের বেশি নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে রয়েছে বহু নারী ও শিশু।

“বিমান বাহিনী না থাকলে সামরিক বাহিনীর পতনের সম্ভাবনা বেশি,” বলেন ক্যাপ্টেন অং।

তিনি যখন বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন তখন সামরিক বাহিনী থেকে পালিয়ে আসা অন্যান্যদের মতো তার পরিবারও তাকে নিয়ে গর্বিত ছিল। তিনি বলেন, সেসময় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর অংশ হতে পারা গর্বের বিষয় ছিল। তবে এই বাহিনীর অভ্যুত্থান “আমাদেরকে রসাতলে নিয়ে গেছে”।

“বিমান বাহিনীতে আমি যাদের সঙ্গে কাজ করেছি তাদের বেশিরভাগই খারাপ লোক ছিল না। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর থেকে তারা পিশাচের মতো কাজ করছে।”

তবে তার ইউনিটে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি পালিয়ে এসেছেন। তার বেশিরভাগ বন্ধুই “আমাদের নিজেদের লোকজনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে,” বলেন তিনি।

মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এই বাহিনীর প্রকৃত সৈন্য সংখ্যা কতো তা অজানা। বেশিরভাগ পর্যবেক্ষকের ধারণা অভ্যুত্থানের সময় তাদের সংখ্যা ছিল তিন লাখের মতো, কিন্তু এই সংখ্যা এখন অনেক কমে গেছে।

এসএইচ-০৫/০১/২৩ (আন্তর্জাতিক ডেস্ক)