ক’দিন পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের ‘সফলতা’ প্রচার করছেন পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি দুবাইয়ে পলাতক আরাভ খান। সুদূর আরব আমিরাতে বসে এভাবেই লাগাতার দাপট দেখিয়ে যাচ্ছেন ইন্টারপোলের রেড নোটিশভুক্ত ফেরারি এই খুনি।
বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, আরাভ খান সম্প্রতি অস্ত্র মামলায় ১০ বছরের কারাদণ্ড পাওয়ার কাগজপত্র ইন্টারপোল ও দুবাই পুলিশকে পাঠানো হয়েছে। তাকে ফেরাতে সব ধরনের চেষ্টা চলছে। তবে দুবাই থেকে আরাভকে ফেরাতে কতদিন লাগবে- সে প্রশ্নের উত্তর নেই পুলিশের কাছে।
এদিকে ঈদুল আজহা ঘিরে আরাভ খানকে সরব দেখা গেছে ফেসবুকে। চিত্রা হরিণ, ব্রাহমা গরু, উট, দুম্বা ও ছাগল কোরবানি দেওয়ার খবর জানিয়েছেন তিনি। বলেছেন ট্রাভেল এজেন্সি খোলা ও তার স্বর্ণের দোকানে বাংলাদেশি প্রবাসীদের জন্য বিশেষ মূল্য ছাড় দেওয়ার খবরও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদিও বাংলাদেশের সঙ্গে দুবাইয়ের কোনো বহিঃসমর্পণ চুক্তি নেই, আর আরাভ দুবাইয়ে গেছেন ভারতের পাসপোর্টে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ও দুবাইয়ের সম্পর্কের ওপর নির্ভর করছে আরাভকে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি।
সম্প্রতি আরাভকে দেশে ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে ‘বাংলাদেশের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়’ বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান মন্তব্য করলেও বাস্তবতা দাঁড়িয়েছে ভিন্ন। আরাভকে ফেরত পাওয়ার বিষয়ে আশা জাগানিয়া কোনো খবর নেই বাংলাদেশ পুলিশের কাছে। এমনকি আরাভের সঙ্গে বাংলাদেশে অবস্থানকারী বা বিদেশে থাকা কোনো বাংলাদেশিদের যোগসাজশ রয়েছে- কার্যত থেমে আছে সে তদন্তও।
যদিও আরাভ ইস্যু আলোচনায় আসার পর তার ঘনিষ্ঠদের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হলেও সে বিষয়ে এখন আর কোনো দৃশ্যমান তৎপরতা নেই।
তবে আরাভকে ফেরানোর কাজটি কনটিনিউ প্রসেস (চলমান প্রক্রিয়া) বলে ঢাকা টাইমসকে বলেছেন পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মনজুর রহমান। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা তৎপরতা চালাচ্ছি। নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে ইন্টারপোল ও দুবাই পুলিশের সঙ্গে। পুলিশ সক্রিয় রয়েছে।’
আরাভ খান ১০ বছর কারাদণ্ড পাওয়ার পর পুলিশ নতুন কোনো তৎপরতা চালিয়েছে কি না- জানতে চাইলে এআইজি মনজুর রহমান বলেন, ‘আরাভ খানের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছে পুলিশ। কারাদণ্ড পাওয়ার কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট দেশের পুলিশ ও ইন্টারপোলকে সরবরাহ করা হয়েছে।’
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, গত ৯ মে আদালত অস্ত্র মামলায় আরাভ খানকে ১০ বছর কারাদণ্ড দিয়েছেন। সেই কাগজপত্র ইন্টারপোল ও দুবাই পুলিশকে পাঠানো হয়েছে। এর আগে আরাভ খান কোনো মামলায় দণ্ডিত ছিলেন না। এই প্রমাণাদি তাকে দেশে ফেরাতে গুরুত্ব পাবে।
বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগকারী ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) ডেস্ক সূত্র জানিয়েছে, আরাভের বিষয়ে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে। তবে কতদিন লাগতে পারে সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছে না এনসিবি ডেস্ক।
ইন্টারপোল রেডনোটিশ জারি করলেও আরাভকে দেশে ফিরিয়ে আনা নিয়ে বেশকিছু অনিশ্চয়তাও রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইন্টারপোল নিজে কাউকে গ্রেপ্তার করে না। সদস্য রাষ্ট্রের পুলিশকে অনুরোধ জানায় ওই অপরাধীকে যেন আইনের আওতায় নেওয়া হয়। তখন ওই দেশের পুলিশ তাদের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, আরাভ খানকে দেশে ফেরানো নির্ভর করছে বাংলাদেশ, ভারত ও দুবাই সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক বা বোঝাপড়ার ওপর। তাকে দেশে ফেরাতে ভারতীয় পাসপোর্ট বাতিল করতে হবে। কেননা তিনি দুবাই অবস্থান করছেন ভারতীয় পাসপোর্টে। এরপর দুবাই সরকার আরাভ খানকে বাংলাদেশের কাছে দিতে রাজি হলে তাকে সেখানে গ্রেপ্তার করতে হবে। এরপর বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে ইস্যু করা ট্রাভেল পাসের মাধ্যমে দেশে ফেরানো যাবে এই অপরাধীকে।
আরাভ খানকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পলাতক যে কোনো আসামিকে কূটনৈতিক ও পুশব্যাকের (কোনো দেশ নিজেদের উদ্যোগেই যদি ফেরত পাঠায়) মাধ্যমে দেশে ফেরত আনা যায়। কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় বহিঃসমর্পণ চুক্তি না থাকলেও অপরাধীকে ফেরানো যায়। তবে চুক্তি থাকলে দুই দেশের মধ্যে এক ধরনের বাধ্যবাধকতা থাকে। এতে অপরাধীকে ফিরিয়ে আনা তুলনামূলক সহজ। চুক্তি না থাকলে অপরাধী ফিরিয়ে আনার বিষয়টি দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে। যেহেতু চুক্তি নেই সেক্ষেত্রে আরাভ খানকে ফিরিয়ে আনাও সম্পর্কের ওপর নির্ভর করছে। তবে প্রথম বাধা দুবাইয়ের বর্তমান নীতি। উদার বাণিজ্যনীতির কারণে দুবাই বিভিন্ন দেশের ধনীদের স্বর্গরাজ্য। এছাড়া অন্য কেনো দেশে করা অপরাধের জন্য দুবাই কাউকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করে না।
এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোখলেসুর রহমান বলেন, ‘ইন্টারপোল যদি খবর পায় যে অভিযুক্ত কোনো দেশে অবস্থান করছে, ইন্টারপোল সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে।’
ইন্টারপোল যদি সহযোগিতা করে থাকে তাহলে রবিউল ইসলামকেও ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।
তিন বছর আগে লিবিয়ায় ২৬ জন বাংলাদেশি হত্যাকাণ্ডের পর মানব-পাচারকারীদের ধরতে ইন্টারপোলের সহযোগিতা চেয়েছিল বাংলাদেশ- এ উদাহরণ টেনে মোখলেছুর রহমান আরও বলেন, ‘তাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ছয়জনের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল। এর মধ্যে দুইজনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়।’
ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে সোমবারও ওয়ান্টেটের তালিকায় রবিউল ইসলাম রবিউল অর্থাৎ আরাভ খানের নাম দেখা গেছে। আরাভের পাসপোর্টে রবিউল ইসলাম নাম থাকায় ওই নামেই রেড নোটিশ জারি করেছে ইন্টারপোল।
এদিকে রেড নোটিশ জারি থাকা কোনো অপরাধীকে সরাসরি ইন্টারপোল হেফাজতে নেয় না জানিয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নুরুল হুদা ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘যে দেশের অনুরোধে ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে, সেই দেশে অপরাধীকে ফিরিয়ে দিতে গ্রেপ্তারস্থল দেশের আইনে কোনো বাধা না থাকলে অপরাধীকে সংশ্লিষ্ট দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে দেওয়া হয়।’
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি থাকার পর সেই অপরাধীকে সংশ্লিষ্ট দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি অপরাধী অবস্থান করা দেশের পলিসির ওপর নির্ভর করে।
এদিকে ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে দুবাইয়ে অবস্থান করা আরাভকে দুবাই পুলিশ ফেরত দেবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। আরাভ খান ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে দুবাই অবস্থান করছেন সে কারণে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি দুবাইয়ে নিজের স্বর্ণের দোকান আরাভ জুয়েলার্স উদ্বোধন ঘিরে আলোচনায় আসে পুলিশ পরিদর্শক মামুন হত্যা মামলার পলাতক আসামি আরাভ খানের নাম। গত ২৩ মার্চ বাংলাদেশি অপরাধী হিসেবে ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায় রবিউল ইসলাম রবিউলের নাম যুক্ত হয়েছে।
২০১৮ সালের ৮ জুলাই বনানীতে আরাভের অফিসে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন ইমরান খানকে হত্যা করা হয়। পরে তার মরদেহ পুড়িয়ে দেয় তারা। এ ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয় আরাভ খান ওরফে রবিউল ওরফে হৃদয়কে। যিনি এখন শত কোটি টাকার মালিক। তার অর্থের উৎস নিয়ে আছে ধোঁয়াশা।
এসএইচ-১২/০৪/২৩ (আন্তর্জাতিক ডেস্ক)