মিশরের পর এবার সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর শেষ করলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের পর এটি আমিরাতে মোদির পঞ্চম সফর। গত মাসের জুনের শেষ দিকে মোদি মিশরে দুদিনের সফর শুরু করার সাথে সাথে কিছু বিশ্লেষক সফরটিকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য একটি সম্ভাব্য ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছেন।
এই সফরটির মধ্য দিয়ে উত্তর আফ্রিকার দেশটিতে ভারতের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে এবং মিশরের জন্য ব্রিকস অর্থনৈতিক জোটে যোগ দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে আশা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মিশরে এটি মোদির প্রথম সফর এবং ১৯৯৭ সালের পর এটিই হচ্ছে কায়রোতে কোন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় সফর। চলতি বছরের জানুয়ারিতে মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির নয়াদিল্লি সফরের কয়েক মাস পর এমন সম্ভাবনা দেখা গেছে। তিনি ভারতের ৭৪তম প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। আল-সিসি প্রথম মিশরীয় প্রেসিডেন্ট যিনি এই সম্মানে ভূষিত হন। খবর বিবিসি।
এদিকে, শনিবার সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ানের সাথে আলোচনার পর, তিনি ভারতীয় রুপি এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মুদ্রা দিরহামে ব্যবসা করার ঘোষণা দেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি আশা প্রকাশ করেছেন যে শীঘ্রই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ৮৫ বিলিয়ন থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে।
দুই দেশের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্যের ঘোষণা ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি নতুন মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গত কয়েক বছরে ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সম্পর্কের মধ্যে অনেক উষ্ণতা দেখা দিয়েছে।
গত বছর যখন মোদি সংযুক্ত আরব আমিরাত পৌঁছেছিলেন, তখন দেশটির প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল-নাহিয়ানকে প্রোটোকল ভেঙে মোদিকে স্বাগত জানাতে আবুধাবি বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত নরেন্দ্র মোদীকে তার সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘অর্ডার অফ জায়েদ’ প্রদান করেছে।
আট বছরে মোদির পঞ্চম ইউএই সফর
নরেন্দ্র মোদি গত নয় বছর ধরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে আছেন। এ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তিনি উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক জোরদারের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছেন। ২০১৪ সালে মোদি যখন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তখন ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গাকে ঘিরে উপসাগরীয় দেশগুলোয় তার যে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল ভারতের সাথে ওই সব দেশের সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। কিন্তু উল্টো তিনি উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক জোরদার করার পদক্ষেপ নিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছেন।
তিনি তার শাসনকালের আট বছরের উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। মোদি এ নিয়ে একাধিকবার সংযুক্ত আরব আমিরাত বা ইউএই তে সফর করেছেন। দেশটিতে তার প্রথম সফর ছিল ২০১৫ সালে অগাস্টে , দ্বিতীয়টি ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে এবং তৃতীয়টি ২০১৯ সালের অগাস্টে এবং চতুর্থটি ২০২২ সালের জুনে। বর্তমান সফরটি তার সংযুক্ত আরব আমিরাতে পঞ্চম সফর।
২০১৫ সালের আগস্টে মোদি যখন প্রথমবারের সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন, এটি ছিল ৩৪ বছরের ইতিহাসে কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ওই দেশে প্রথম সফর। মোদির আগে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮১ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেছিলেন।
২০১৭ সালে প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে মোদির পররাষ্ট্র নীতিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া হয়েছিল। সেই সময় মোহম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল মোদী সরকার। তখন মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট ছিলেন না, তখন তিনি ছিলেন আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স।
ঐতিহ্য অনুসারে, ভারত তাদের প্রজাতন্ত্র দিবসে কোন একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতিকে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানায়। আল নাহিয়ান ওই পদে না থাকা সত্ত্বেও ২০১৭ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথি হিসেবে তিনি এসেছিলেন।
ভারত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ইংরেজি বর্ণমালার তিনটি ই এর উপর ভিত্তি করে আছে। সেগুলো হল এনার্জি, ইকোনমি, এক্সপ্যাট্রিয়েট অর্থাৎ জ্বালানি, অর্থনীতি এবং জনশক্তি (প্রবাসী)।
গত অর্থ বছরে (২০২২-২৩), ইউএই ভারতে অপরিশোধিত তেল সরবরাহকারী তৃতীয় বৃহত্তম দেশ ছিল। ভারতের তেল আমদানিতে এর দশ শতাংশ শেয়ার ছিল।
কিন্তু ভারত এখন ২০৩০ সালের মধ্যে ইউএই থেকে তেলের বাইরে অন্যান্য ব্যবসা ১০০ বিলিয়ন ডলারে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভারত ২০২৭ সালের মধ্যে তার অর্থনীতির আকার পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়৷ এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য, দেশটি ২০৩০ সালের মধ্যে তার রপ্তানি এক ট্রিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায়৷ সিইপি চুক্তি এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে৷
ভারতীয় কমিউনিটির মানুষেরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের মেরুদণ্ড। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রায় এক কোটি জনসংখ্যার ৩৫ শতাংশ ভারতীয় প্রবাসী। এই মানুষেরা সেখানে প্রতিটি সেক্টরে কাজ করে। যা সংযুক্ত আরব আমিরাতের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অপরিহার্য। ভারত উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। ২০২০ সালে, সারা বিশ্বে বসতি স্থাপনকারী ভারতীয়রা তাদের নিজ দেশে ৮৩ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছে।
মোদির মিশর সফর
মিশর সফরের মধ্য দিয়ে উত্তর আফ্রিকার দেশটিতে ভারতের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে এবং মিশরের জন্য ব্রিকস অর্থনৈতিক জোটে যোগ দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মিশরে এটি মোদির প্রথম সফর এবং ১৯৯৭ সালের পর এটিই হচ্ছে কায়রোতে কোন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় সফর।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে মিশরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির নয়াদিল্লি সফরের কয়েক মাস পর এমন সম্ভাবনা দেখা গেছে। তিনি ভারতের ৭৪তম প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। আল-সিসি প্রথম মিশরীয় প্রেসিডেন্ট যিনি এই সম্মানে ভূষিত হন।
মোদির সফরটিকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারে শক্তিশালী চলক হিসেবে দেখা হচ্ছে। সেই সঙ্গে আল-সিসির জানুয়ারি সফরের সময় উভয় পক্ষ এরিই মধ্যেই সর্ম্পক কৌশলগত স্তরে উন্নীত করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন যে, এটি সামনের দিনগুলোতে কীভাবে সম্পর্ককে আরও জোরদার করা যায় তার রূপরেখাও প্রকাশ করতে পারবে।
“প্রেসিডেন্ট সিসির ভারত সফরের মাত্র ছয় মাসের মধ্যে মোদির সফরটি খুব দ্রুততার সঙ্গে হয়েছে এবং এটি একটি পারস্পরিক ও দ্বিপক্ষীয় সফর। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বলেন, ‘আমরা আশা করি এবং আত্মবিশ্বাসী যে এই সফর আমাদের দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অব্যাহত গতিই নিশ্চিত করবে না, বরং বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার নতুন ক্ষেত্রগুলোকে বলিষ্ট করতে সহায়তা করবে।
মিশরের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই সফর পশ্চিমা ব্লকের বাইরে অংশীদারত্বকে বৈচিত্র্যময় করার বিশেষ সুযোগ সৃষ্টি করবে। ভারতের জন্য, পর্যবেক্ষকরা বলেছেন যে, সফরটি গ্লোবাল সাউথের পক্ষে কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত নয়াদিল্লির অবস্থানকে আরও সুসংহত করবে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে রাজধানী নয়াদিল্লিতে জি-২০ জোটের বৈঠক আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে।
দ্বিপাক্ষিক আলোচনা এবং বিভিন্ন বাণিজ্য চুক্তি সই ছাড়াও, মোদি সেখানে ভারতীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের কিছু বিশিষ্ট নেতার সঙ্গে আলাপচারিতা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
ভারত এবং মিশর ঐতিহাসিকভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক উপভোগ করেছে কারণ দেশ দুটি ১৯৬১ সালে নন-অ্যালাইনমেন্ট মুভমেন্ট (ন্যাম)-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিল। ন্যাম ১২০টি উন্নয়নশীল দেশের একটি বৈশ্বিক ফোরাম যারা সেই সময় প্রধান দুটি বৈরিতাপূর্ণ ব্লক- যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কোনটিতেই পক্ষে যোগ না দেয়ার অবস্থানে বিশ্বাস করত।
এসএইচ-০৭/১৬/২৩ (আন্তর্জাতিক ডেস্ক)