৮ বছর পর বাবার পরিচয় মিললেও স্বীকৃতি মেলেনি জুঁইয়ের

জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার কুসুম্বার চকসিধইল গ্রামের হত দরিদ্র পরিবারের বাকপ্রতিবন্ধী জয়নব বেগম ২০১১ সালের দিকে প্রতিবেশী আবুল কালামের বখাটে ছেলে ফেরদৌস আলমের লালসার শিকার হন। ফেরদৌস কৌশলে জয়নবকে তার নিজ বাড়িতে নিয়ে শারীরিকভাবে মিলিত হয়। একপর্যায়ে বাকপ্রতিবন্ধী মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে বিষয়টি জানাজানি হয়।

জয়নব ও তার পেটের সন্তানকে মেনে নিতে জয়নবের দরিদ্র বাবা-মা অনেক অনুনয়-বিনয় করেও মন গলাতে পারেনি ফেরদৌস আলম ও তার পরিবারের। জয়নবের পরিবার বিষয়টি গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের মীমাংসার জন্য বললেও তারা মীমাংসা করেনি। ফলে বাধ্য হয়ে জয়নবের পরিবার ২০১২ সালে থানায় অভিযোগ দিলে ঘটনাটি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এরই মধ্যে বাকপ্রতিবন্ধী জয়নব ফুটফুটে কন্যা শিশুর জন্ম দেন। শিশুটির নাম রাখা হয় জুঁই।

আদালতে এ নিয়ে মামলা চলার একপর্যায়ে ডিএনএ পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়া যায় শিশুটি ফেরদৌস আলমেরই সন্তান। ডিএনএ পরীক্ষায় ধরা পরলেও এমন গর্হিত অপরাধ থেকে রক্ষা পেতে ফেরদৌস আলম ও তার পরিবার নানা অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে কুসুম্বা ইউনিয়নের কাজী আব্দুর রহমানের সহযোগী বেলাল হোসেন ও গ্রামের স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীদেরকে দিয়ে মোটা অংকের অর্থ সুবিধা দিয়ে ৬০ হাজার টাকা মোহরানা পরিশোধ দেখিয়ে বিয়ের নাটক সাজান ফেরদৌস। যাতে যে কোনো সময় সহজেই তালাক দেয়া যায়। এতে করে কাজীসহ ফেরদৌসের অপকৌশল ধরা পড়ে যায় জয়নব বেগমের বাবা-মার কাছে। ফলে তাদের অপকৌশল আর আলোর মুখ দেখেনি।

ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণিত হলেও শিশু জুঁই নিজ বাবার কাছ থেকে পায়নি কন্যার স্বীকৃতি। এ অবস্থায় ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও পিতৃ পরিচয় না থাকা ও লোকলজ্জার ভয়ে স্কুলে লেখাপড়া করতে পারছে না অবুঝ শিশুটি। সে স্থানীয় একটি মক্তবে পড়ছে। বাকপ্রতিবন্ধী মেয়ে আর নাতনির ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকন্ঠায় রয়েছেন দরিদ্র বাবা-মা।

সিধইল গ্রামের কেউ এ বিষয়ে কথা বলতে না চাইলেও পার্শ্ববর্তী লাটপাড়া গ্রামের মতিয়ার রহমান ও ফেরদৌস আলম বলেন, ৮ বছর আগে বাকপ্রতিবন্ধী মেয়েটির ওপর পাশবিক নির্যাতনের খবর আমরা শুনেছি। এ পর্যন্ত কোনো ভরণপোষণ তার কন্যা শিশুটিকে দেয়া হয় না। কিছুদিন আগে সাজানো একটি বিয়ের রেজিস্ট্রির খবর আমরা জেনেছি। দ্রুত আমরা এর সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।

কুসুম্বা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুক্তার হোসেন মন্ডল জানান, বাকপ্রতিবন্ধী মেয়েটির বিষয়ে আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। আদালত যে রায় দেয় তা আমি বাস্তবায়ন করব। ফেরদৌস আমার কাছেও স্বীকার করেছে কন্যা শিশুটি তার।

বিয়ের নাটক সাজানোর সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন, ওই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত সবাইকে চিনলেও তাদের নাম বলতে পারব না।

এদিকে অনেক চেষ্টা করেও দেখা মেলেনি ফেরদৌস আলমের। এ বিষয়ে তার পরিবার কথা বলতেও রাজি হয়নি।

বাকপ্রতিবন্ধী জয়নবের মা মেহেরুন নেছা বলেন, দীর্ঘ ৮ বছর ধরে মামলা চলছে। আমরা গরীব হওয়ায় প্রভাবশালী ফেরদৌস ও তার পরিবার মামলা থেকে বাঁচতে মামলার প্রথম থেকেই বিভিন্ন রকম কৌশল খাটাচ্ছে। ডিএনএ টেস্টে কন্যা শিশুটি ফেরদৌসের প্রমাণিত হওয়ায় গ্রামের প্রভাবশালীদের নিয়ে ৬০ হাজার টাকা দেনমোহর পরিশোধ দেখিয়ে বিয়ের নাটকের ঘটনাটি আমরা জানার পর পরবর্তীতে আর তা সফল হয়নি। আমি চাই আমার বোবা মেয়ে স্ত্রীর মর্যাদা আর নাতনির পিতার পরিচয়। মেয়েটি বড় হচ্ছে, তাকে লেখাপড়াসহ বিয়ে দিতে হবে। পিতার পরিচয় না থাকলে সবাই তাকে অবৈধ সন্তান বলবে।

শিশু কন্যা জুঁই এ ব্যাপারে কিছু না বলতে পারলেও তার নাম বলেছে জুঁই এবং সে স্থানীয় একটি মক্তবে আমপাড়া পড়ছে।

জেলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী (স্পেশাল পিপি) অ্যাডভোকেট ফিরোজা চৌধুরী জানান, অপকৌশল করলেও ফেরদৌস কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারবে না। যা কিছু করতে হবে আদালতের মাধ্যমেই করতে হবে। বিষয়টি স্থানীয়ভাবে মীমাংসার কোনো সুযোগ নেই। ডিএনএ পরীক্ষা যেহেতু পজিটিভ এসেছে সেহেতু শিশু জুঁইকে বাবার স্বীকৃতি আর বাকপ্রতিবন্ধী জয়নবকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে ফেরদৌস বাধ্য।

বিএ-০৬/২০-০৫ (উত্তরাঞ্চল ডেস্ক)