মৃত্যুর ১১ বছর পর ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেন পরেশ চন্দ্র!

মৃত্যুর ১১ বছর পর আবারও জীবিত হয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করেন জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার পরেশ চন্দ্র! এমন কথা শুনে অবাক হওয়ারই কথা। আর ঠিক এমনটাই ঘটেছে জয়পুরহাটের ক্ষেতলালের সোনালী ব্যাংকে।

মৃত্যুর ১১ বছর পর জীবিত হয়ে ব্যাংকে এসে ঋণ নেয়া পরেশ ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর ইউনিয়নের পাঁচুইল গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তিনি দুই ছেলে দুই মেয়ের জনক। তার বড় ছেলে নরেশ চন্দ্র, ছোট ছেলে পলাশ চন্দ্র, মেয়ে অতীতা বালা ও গৌরি বালা। মৃত পরেশ চন্দ্রের স্ত্রী মাখন বালা জীবিত রয়েছেন বলে জানা গেছে।

তবে তিনি জীবিত হয়ে নিজের বাড়িতে যাননি বা পরিবারের সদস্য, আত্বীয়-স্বজন ও গ্রামবাসীরাও কেউ তাকে দেখেননি। তিনি শুধু গিয়েছিলেন সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল শাখায়। ব্যাংকের ওই শাখায় ঋণ ডকুমেন্টে স্বাক্ষর করে তিনি দশ হাজার টাকা ঋণ গ্রহন করেছিলেন। শুধু ব্যাংকটির কর্মকর্তারা ছাড়া অন্য কেউই তাকে দেখেননি। ব্যাংকে রক্ষিত ঋণ ডকুমেন্ট এমন সাক্ষ্যই দিচ্ছে।

সম্প্রতি সোনালী ব্যাংক লিমিটেড ক্ষেতলাল শাখা থেকে ২৮ বছর আগে পরলোকগমনকারী শ্রী পরেশ চন্দ্রের নামে দশ হাজার টাকা এমসিডি ঋণ পরিশোধের নোটিশ খামে ভরে পাঠানো হয়। ডাকযোগে পাঠানো ব্যাংকের রেজিষ্ট্রিকৃত চিঠিটি মৃত পরেশ চন্দ্রের বড় ছেলে নরেশ চন্দ্র গ্রহণ করেন। চিঠি খুলে তিনি তার বাবার নামে ব্যাংকের দশ হাজার টাকার এমসিডি ঋণ পরিশোধের নোটিশ দেখতে পান। নোটিশে এক নজর চোখ বুলিয়ে ভেবেছিলেন জীবিত থাকতে হয়তো তার বাবা ঋণ নিয়েছিলেন। এতোদিন পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ঋণ পরিশোধের নোটিশ দিয়েছে। নোটিশের নিচের অংশ গিয়ে তার বাবার ঋণ গ্রহনের তারিখ দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়।

নোটিশে তার বাবার ঋণ গ্রহণের তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর। এটি দেখেই নরেশ তখন ছুটে যান সোনালী ব্যাংক ক্ষেতলাল শাখায়। ব্যাংকের কর্মকর্তাও তার বাবার ঋণের নথিপত্র ঘেঁটে ঋণ গ্রহনের তারিখ সঠিক বলে জানান তাকে।

তখন নরেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের জানান যে তার বাবা পরেশ চন্দ্র ২৮ বছর আগে অথাৎ ১৯৯৪ সালে মারা গেছেন। ব্যাংকের কর্মকর্তা উত্তরে তাকে বলেন যে, আপনার বাবা শ্রী পরেশ চন্দ্র ২০০৫ সালের ৩১ অক্টোবর ঋণের নথিপত্রে স্বাক্ষর দিয়ে ঋণ গ্রহণ করেছেন। ঋণের নথিতে আপনার বাবার নাগরিকত্ব সনদ, ছবি, জমির কাগজপত্র, স্বাক্ষরসহ প্রয়োজনীয় সবই আছে।

পরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ব্যাংকে রক্ষিত ৩২৮ নম্বর এমসিডি ঋণের নথিপত্রে পরেশ চন্দ্রের নাম রয়েছে। তিনি ছবি, নাগরিকত্ব সনদ, জমির কাগজ দিয়ে ঋণ ডকুমেন্টে স্বাক্ষর দিয়ে দশ হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করেছেন। ঋণ পরিশোধের পাঠানো নোটিশের সঙ্গে তার মিলও রয়েছে।

স্থানীয় আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে নরেশের কথার সত্যতা পাওয়া যায়। আলমপুর ইউনিয়নের ১৯৮৭ সালের ফেরুয়ারি মাসের মৃত্যু রেজিস্ট্রারে দেখা যায় ৩৮ নম্বর পাতার ৪৩ নম্বর সিরিয়ালে পাঁচুইল গ্রামের শ্রী পরেশ চন্দ্রের নাম রয়েছে। তার মৃত্যুর তারিখ ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন। তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে সেখানে বুকের ব্যথার কথা উল্লেখ রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা, ইউপি চেয়ারম্যান, ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যরাও জানালেন ১৯৯৪ সালের ওই তারিখে পরেশ চন্দ্রের পরলোক গমনের কথা। আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ২০২১ সালের ৯ মার্চ মাসে নরেশ চন্দ্রকে তার বাবার মৃত্যুর সনদ দেয়া হয়েছে। তাতেও তার মৃত্যুর তারিখ ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন উল্লেখ আছে।

ঋণগ্রহীতার ছেলে নরেশ চন্দ্র বলেন, দশ হাজার টাকা বড় কথা নয়। আমার বাবা তার মৃত্যুর ১১ বছর পর কীভাবে ব্যাংকে গিয়ে ঋণ গ্রহণ করলেন তাতেই আমরা আশ্চর্য হয়েছি। আমার বাবার ১২-১৪ বিঘা জমি রয়েছে। আমার বাবা জীবিত থাকা অবস্থায়ও কোনো ঋণ নেননি। আমরা আগে কখনও বাবার নামে থাকা ঋণ পরিশোধের কোনো নোটিশও পাইনি।

আলমপুর ইউপি সদস্য আব্দুল হালিম জানান, আমার ওয়ার্ডের পাঁচুইল গ্রামের শ্রী পরেশ চন্দ্র ১৯৯৪ সালের ২৮ জুন মারা গেছেন। সেই ব্যক্তি ২০০৫ সালে সোনালী ব্যাংক থেকে কিভাবে দশ হাজার টাকা নিয়েছেন তা জেনে হতবাক হয়েছি।

সোনালী ব্যাংকের ক্ষেতলাল শাখায় সেই সময় কৃষি ও এমসিডি ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছিল দাবি করে তিনি জানান, পাঁচুইল গ্রামের কার্তিক চন্দ্রের ছেলে শ্রী নরেশ চন্দ্রের নামেও ১৫ হাজার টাকার ঋণ পরিশোধে নোটিশ দেয়া হয়েছে। নোটিশে তার ঋণ গ্রহণের তারিখ ২০০৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর দেখানো হয়েছে।

আলমপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আনোয়ারুজ্জামান তালুকদার নাদিম জানান, পাঁচুইল গ্রামের পরেশ চন্দ্রের মৃত্যুর তারিখ ইউপি কার্যালয়ের মৃত্যু রেজিস্ট্রারে উল্লেখ রয়েছে। ইউপি কার্যালয় থেকে শ্রী পরেশ চন্দ্রের মৃত্যুর সনদ দেয়া হয়েছে। মৃত্যুর ১১ বছর পর কীভাবে তিনি ব্যাংক ঋণ পেলেন তা জেনে খুবই আশ্চর্য হয়েছি। ক্ষেতলাল সোনালী ব্যাংকে এক সময় কৃষি ও এমসিডি ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছিল। এ ঘটনায় তখনকার ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি।

সোনালী ব্যাংক ক্ষেতলাল শাখার একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০০৪ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত প্রায় চার কোটি টাকার কৃষি, এমসিডি ঋণ দেয়া হয়েছিল। এরই ৮০ শতাংশ ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। সেই সময়কার ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর এসব ঋণের দায় বর্তানো হয়েছে। তাদেরমধ্যে কয়েকজন কর্মকর্তা অবসরে গেছেন। ঋণ অনাদায়ী থাকায় তাদের কারও ১৬ লাখ, ৯ লাখ, ২৭ লাখসহ বিভিন্ন অংকের টাকা কেটে নেয়া হয়েছে।

সোনালী ব্যাংক ক্ষেতলাল শাখার ব্যবস্থাপক সিনিয়র প্রিন্সিপাল কর্মকর্তা মো. আহসান হাবিব জানান, ব্যাংকে রক্ষিত ঋণ ডকুমেন্টে দেখা গেছে যে উপজেলার পাঁচুইল গ্রামের শ্রী পরেশ চন্দ্র ২০০৫ সালে কাগজপত্র ও স্বাক্ষর দিয়ে ব্যাংক ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু ঋণটি পরিশোধ হয়নি। এখন ঋণটি শ্রেণিকৃত হয়েছে। এ কারণে ঋণের আসল টাকা পরিশোধের জন্য নোটিশ করা হয়েছে।

মৃত ব্যাক্তি কিভাবে ঋণ নিলেন? প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তখন আমি এখানে শাখা ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে ছিলাম না। এ কারণে সেটি আমার জানার কথাও নয়।

স্থানীয়রা জানান, অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তারা কৌশলে মৃত ব্যক্তিদের নামে ঋণ উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে আসলেও ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয় না।

এসএইচ-০৩/১৪/২২ (উত্তরাঞ্চল ডেস্ক)