ইভ্যালির গ্রাহকদের এখন কী হবে

ইভ্যালির

ইভ্যালির একটি ক্যাম্পেইনে জুলাই মাসে একটি ৩২ ইঞ্চি স্মার্ট টিভি, সিসিটিভি ক্যামেরা, গিফট কার্ড অর্ডার করেছিলেন মিরপুরের পশ্চিম শেওড়াপাড়ার তানভির এহসান। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ই-কমার্স নীতিমালা জারির পর তিনি আশা করেছিলেন, ইভ্যালি নিয়ম মেনে যথাসময়ে পণ্য সরবরাহ করবে। কিন্তু সেই আশার গুড়ে বালি পড়ে। পণ্য কিংবা টাকা বুঝে এখনো পাননি তিনি।

বৃহস্পতিবার ইভ্যালির সিইও মোহাম্মদ রাসেল ও তাঁর স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন গ্রেপ্তার হয়েছেন। তানভির এহসান বলেন, ‘১০ দিনের মধ্যে ডেলিভারির কথা থাকলেও দুই মাসেও পণ্য কিংবা টাকা ফেরত পাইনি। আমার মতো অসংখ্য নতুন গ্রাহকের সঙ্গেও প্রতারণা করেছে ইভ্যালি। আমি এর প্রতিকার চাই।’

শুধু তানভিরের মতো সাধারণ গ্রাহকই নন, ইভ্যালিকাণ্ডে প্রতারিত হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানও। এদের একটি পেপারফ্লাই। দেশজুড়ে পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার মাসুল হিসেবে সাত কোটি টাকা বকেয়া হলেও গত জানুয়ারি থেকে ইভ্যালি কোনো বিল পরিশোধ করেনি। সম্প্রতি পেপারফ্লাইয়ের পক্ষ থেকে ইভ্যালির ঠিকানায় উকিল নোটিশ পাঠানো হয়েছে।

জানতে চাইলে পণ্য বিলিকরণ প্রতিষ্ঠান পেপারফ্লাইয়ের চিফ মার্কেটিং অফিসার রাহাত আহমেদ বলেন, ‘সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরই একটি কম্পানি আইনগত পথ বেছে নেয়। আমরা আইনি নোটিশ পাঠিয়েছিলাম। আগামী সপ্তাহে আমরা মামলা করব। এর পর থেকে আদালত যা বলবেন আমরা তা-ই করব।’

২০১৮ সালে যাত্রা শুরুর পর সাধারণ মানুষকে বাজারের চেয়ে কম দামে লোভনীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে টাকা নেওয়ার উদ্যোগ হিসেবে সাইক্লোন (পরবর্তী সময়ে টি-টেন নামকরণ) অফার দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগ ওঠে ইভ্যালির বিরুদ্ধে। সাত থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে পণ্য ডেলিভারির প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে আগাম টাকা নিলেও তাদের পণ্য সরবরাহ করেনি ইভ্যালি। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে আগাম মূল্য পরিশোধ করা অনেক গ্রাহক এখনো পণ্য পায়নি। ইভ্যালি যেসব গ্রাহককে রিফান্ড চেক দিয়েছে, ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকায় সেগুলোও বাউন্স হচ্ছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, শুধু ব্যবসায়ীদের কাছে ইভ্যালির বকেয়া ২০৫ কোটি টাকার ওপরে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ইভ্যালির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত তাদের কাছে বিভিন্ন পর্যায়ের গ্রাহকদের পাওনা রয়েছে ৫৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে দুই লাখ সাত হাজার ক্রেতা পাবে ৩১১ কোটি টাকা। আর পণ্য সরবরাহকারী মার্চেন্টরা পায় ২০৬ কোটি টাকা। এ ছাড়া বাকি ২৬ কোটি টাকা পায় অন্য খাতের গ্রাহক। ইভ্যালির হিসাব অনুযায়ী, দায়ের বিপরীতে এর চলতি সম্পদ রয়েছে ৯০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর সম্পত্তি, স্থাপনা ও যন্ত্রপাতি মিলিয়ে রয়েছে ১৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।

টাকা নিয়ে পণ্য না দেওয়ার চর্চা ই-কমার্স খাতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করেছে বলেও মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাঁরা বলছেন, ইভ্যালির গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা আপাতত ক্ষীণ। কারণে দেনা পরিশোধের মতো সম্পদ প্রতিষ্ঠানটির নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে ছয় মাসের মধ্যে দেনা শোধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা পূরণ করতে পারেননি প্রতিষ্ঠানের এমডি। গ্রেপ্তার হওয়া ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিষয়ে এখন আদালত সিদ্ধান্ত নেবেন অথবা জনস্বার্থে এ কম্পানিতে ডেসটিনি, যুবকের মতো কাস্টডিয়ান দিতে পারেন।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আজকের ডিলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘আমার ধারণা ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী গ্রেপ্তার না হলেও গ্রাহকরা টাকা পেত না, গ্রেপ্তার হয়েও গ্রাহকরা টাকা পাবে কি না যথেষ্ট সন্দেহ আছে। টাকা পাবে কোথা থেকে, টাকা তো টাকা খরচ হয়ে গেছে কিংবা অন্যত্র চলে গেছে। যদি দিতে পারত তাহলে গত চার-পাঁচ মাস তিনি যে সময় নিয়েছেন সেই সময়ে টাকা ফেরত দিতে পারতেন। গত এক বছরে বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপকভাবে টাকা ঢেলেছে ইভ্যালি। স্পন্সরশিপ, বিজ্ঞাপন, প্রডাক্ট ডিসকাউন্ট, সেলিব্রেটিদের পকেটেও টাকা গেছে। দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে কি না তাও তদন্ত করে দেখা উচিত। প্রাইভেট লিমিটেড কম্পানির এমন ঘটনা ঘটলে নিয়ম হচ্ছে সম্পদ বিক্রি করে দেনা শোধ করা। ইভ্যালির যদি দেনার পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা হয়, তাদের সম্পদ বিক্রি করে ২০ কোটি টাকাও হবে না।’

তিনি বলেন, ‘এটা নতুন ঘটনা নয়, আরো এক বছর আগে থেকে ঘটছিল। আমরা বিভিন্ন মহলে বলে আসছিলাম। আরো আগে পদক্ষেপ নেওয়া গেলে ক্ষতির পরিমাণ আরো কম হতো। গ্রাহক ও মার্চেন্টদের টাকা যা যাওয়ার চলেই গেছে। সরকার এই টাকার দায়িত্ব নিতে আইনগতভাবে বাধ্যও নয়। পি কে হালদারের প্রতিষ্ঠান, ডেসটিনির মতো প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাহকরা টাকা ফেরত পায়নি। ইভ্যালির গ্রাহক ও মার্চেন্টদের খুব আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু দেখি না। যদি অনেক সম্পদ থাকত, ব্যাংকে টাকা থাকত তাহলে আইনগতভাবে কিছু পাওয়ার সুযোগ ছিল।’

ইভ্যালির গ্রাহক ও মার্চেন্টদের টাকা ফিরে পেতে ভোক্তা অধিকারে যাওয়া উচিত বলে মনে করেন দেশের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ তমাল। গতকাল তিনি বলেন, ‘ইভ্যালি নিয়ে ভোক্তা স্বার্থ দেখার দায়িত্ব ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের। যেগুলো সেটেলমেন্ট পেমেন্টের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক দেখতে পারে। আদালতও কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিতে পারেন। আমরা সরকারি সংস্থাগুলোকে সঙ্গে নিয়ে একটি সেন্ট্রাল কমপ্লেইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম দাঁড় করাচ্ছি। এখানেও গ্রাহকরা অভিযোগ জানাতে পারবেন।’ তিনি বলেন, ‘যে কম্পানি বন্ধ হয়ে গেছে কিংবা যেগুলো বন্ধের পথে সেগুলোর অভিযোগ কিভাবে নিষ্পত্তি হবে সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত আসবে বলে আমরা আশা করি। সরকার যদি চায় যেসব ক্ষুদ্র মার্চেন্ট ইভ্যালির সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের বিনা সুদে ঋণ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। যে টাকা রয়ে গেছে, সেটা আগের অর্ডারের ভিত্তিতে সেটেলমেন্ট করা উচিত। জমি ও অন্যান্য সম্পদ বেচেও এত টাকা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। এই মডেলটি কোনো যৌক্তিক মডেল না। তারা তো ব্যাংক না যে মানুষের টাকা নেবে।’

ইভ্যালির ব্যাপারে ই-ক্যাব আগে থেকে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে কি না জানতে চাইলে আব্দুল ওয়াহেদ তমাল বলেন, ‘ই-ক্যাব থেকে ২০২০ সালে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছিলাম। তাতে বলেছিলাম, এভাবে ব্যবসা করতে দেওয়া যায় না। এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর) করতে হবে। আমাদের উদ্যোগে পরবর্তী সময়ে এসওপি চূড়ান্তভাবে কার্যকর হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো বড় ভূমিকা নিতে হতো। এখানে যে লেনদেনগুলো হচ্ছে তা ট্র্যাক করে আরো আগে ব্যবস্থা নিতে হতো। সরকার শক্ত পদক্ষেপ না নিলে আরো ছয় মাসে অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতো। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’

এখনো ইভ্যালির সদস্য পদ বাতিল করা হয়নি কেন জানতে চাইলে ই-ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আমরা তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিলাম। তারা সময় চেয়েছিল। আগামী মাসে ওই সময় শেষ হচ্ছে। আমরা দু-এক দিনের মধ্যে তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।’

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাল কমার্স সেলের প্রধান হাফিজুর রহমান গতকাল শুক্রবার বলেন, ‘যেহেতু মামলা হয়েছে, তাই এখন এটি আদালত দেখবেন। গ্রাহকদের আমরা অনেক আগে থেকেই অনুরোধ করে আসছি, তারা যেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ দায়ের করে। এখনো সময় আছে, তাদের এটা করা উচিত বলে আমি মনে করি। তাহলে একটি লিগ্যাল ডকুমেন্ট থাকে। পরে যে সমাধানই আসুক না কেন তখন এটি লিগ্যাল ডকুমেন্ট হিসেবে কাজে লাগবে।’

এদিকে ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ রাসেল জানেন না তিনি কবে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারবেন। রাজধানীর গুলশান থানায় প্রতারণা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবকে এ কথা জানিয়েছেন তিনি। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে রাসেল জানিয়েছেন, ইভ্যালির দেনা প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। গ্রাহকসংখ্যা ৪৪ লাখ বলে দাবি তাঁর।

তথ্যসূত্র: কালের কণ্ঠ