ব্রাজিলে যেভাবে রোজা-তারাবি পালিত হয়

মুসলিম বিশ্বের মহিমান্বিত মাস রমজান। এ মাস ঘিরে নানা অনুষ্ঠান আর রীতি-রেওয়াজ আছে। রোজা রাখা, ইফতারের পর তারাবির নামাজ পড়া ইত্যাদি ছাড়াও আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় খুশির আমেজ। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের চেয়েও এসব রীতি সাংস্কৃতিক উদযাপন হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। জনসংখ্যার দিক দিয়ে মাত্র ২.৫% মুসলিম দেশ ব্রাজিল। এরপরও ব্রাজিলের মুসলিম জনগণ অত্যন্ত সচেতনভাবে ইসলামি বিশ্বাস, চেতনা ও সংস্কৃতির লালন করে আসছে। সেখানে যেভাবে রমজান পালিত হয়।

ব্রাজিলে ইসলাম যেভাবে এলো
ব্রাজিলে ইসলামের আগমন হয়েছে আরব, আফ্রিকা ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে আগত মুসলিম অভিবাসীদের মাধ্যমে। ব্রাজিলিয়ান মুসলিমদের বড় একটি অংশ সিরিয়া থেকে আগত। উনিশ শতকের শেষভাগে এবং বিশ শতকের শুরুতে সিরিয়াসহ আরব দেশগুলো থেকে বিপুল সংখ্যক মুসলিম অভিবাসী ব্রাজিলে পাড়ি জমায়। ব্রাজিলে ইসলামের অস্তিত্ব উনিশ শতকের বহু আগে হলেও এ সময়কালকে ব্রাজিলে মুসলিম সমাজের গঠন ও বিকাশের স্বর্ণযুগ বলা হয়। বর্তমানে ব্রাজিলে স্থানীয় ও অভিবাসী মিলিয়ে প্রায় ২৫ লাখ মুসলিম বসবাস করে। ১৫০টির মতো মসজিদ রয়েছে এবং ৮০জন আলেম ইসলাম প্রচারের কাজে নিয়োজিত আছেন।

একসঙ্গে মিলেমিশে ধর্মীয় কাজ পালন
১৯০০ সালের শুরুতেও ব্রাজিলের মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ১ লাখের মতো। এরপর ধীরে ধীরে গত শতাব্দীর শেষ দিকের বিভিন্ন সময় লেবানন-সিরিয়া-জর্ডান এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মুসলমানরাও পাড়ি জমান দক্ষিণ আমেরিকার এ দেশে। রিও ডি জেনরিওতে মুসলিমদের ইসলামিক সেন্টার এবং বড় মসজিদ আছে কয়েকটা। আমাজানের দেশে রাজধানী ছাড়া অন্য দুটি শহরে মূলত মুসলিম কমিউনিটি চোখে পড়ে। রমজান এলে সাও পাওলো এবং পারানায় পরিবর্তন চোখে পড়ে। ব্রাজিলের রাজধানী ও বড় এ দুই শহরসহ গোটা দেশের মুসলিম কমিউনিটিতে অন্যরকম আবহ তৈরি হয়। রমজান মাস এলে এখানকার মুসলমানগণ একসঙ্গে মিলেমিশে ধর্মীয় কাজগুলো পালন করেন। নারী-পুরুষ সবাই নিয়মমতো মসজিদে নামাজ আদায় করেন।

রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সুফল
সংখ্যায় স্বল্প হলেও ব্রাজিলিয়ান মুসলিমদের ঐক্যের কারণে তারা রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সুফল ভোগ করে। যে কোনো সমস্যা তারা সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। ব্রাজিলের বৃহৎ দুটি মসজিদ হলো ফোজ ডো এগাসিও শহরে অবস্থিত মসজিদে ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) এবং সিও বার্নার ডো কাম্পিও শহরে অবস্থিত মসজিদে আবু বকর (রা.)। সিও বার্নার ডো কাম্পিও শহরকে ব্রাজিলের মুসলিম রাজধানী বলা হয়। কেননা, অধিকাংশ মুসলিম প্রতিষ্ঠান এ শহরেই অবস্থিত।

ধর্মীয় প্রেরণার উৎস রমজান
ব্রাজিলের নাম জানেন না, এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম। তবে ফুটবলের ব্রাজিল আর পেলের ব্রাজিল যেমন বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত, ঠিক এর উল্টো ইসলামি সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিষয়ে। মুসলমানরা ব্রাজিলিয়ান সমাজে স্বকীয়তা রক্ষা করেই চলছে এবং ইসলামি রাষ্ট্রের দাওয়াতি সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজ দেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। রমজান মাসে তাদের প্রচেষ্টা আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। রমজান তাদের কাছে ধর্মীয় অনুপ্রেরণার উৎস।

রমজানে দান-অনুদান
ব্রাজিলের মুসলিম সংগঠনগুলো স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরতে বহুমুখী কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। তাদের বেশ কিছু সমাজসেবামূলক কার্যক্রমও রয়েছে। ব্রাজিলে অবস্থানকারী মুসলিমগণ তাদের একদিনের আয় একটি ফান্ডে জমা করে এবং মাস শেষে কোনো দারিদ্র্য এলাকার সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করে। রমজানে মাসে তারা আরও অধিক পরিমাণ দান করে। প্রতি সপ্তাহে রিলিফ বিতরণ করে। এ ছাড়া তারা ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প, রক্তদান কর্মসূচি পালন করে।

ভাষার ভিন্নতা ইসলাম প্রচারে বড় বাঁধা
আরব শায়খদের সহযোগিতায় সেখানে কিছু শিক্ষিত মুসলিম তরুণ পথশিশুদের নিয়ে কাজ করছে। ব্রাজিলিয়ান সমাজে তার ইতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্রাজিলে মুসলিম রীতিনীতি পালনের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও রয়েছে। যেমন—আজানে সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা যায় না। ভাষার ভিন্নতা ব্রাজিলে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে একটি বড় বাঁধা।

সর্বপ্রথম তারাবির জামাত যখন
ব্রাজিলের মুসলিমগণ অন্যান্য অমুসলিম দেশের মুসলিমদের ন্যায় রমজানকে ধর্মীয় অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবেই গ্রহণ করে। ব্রাজিলের সবগুলো গণমাধ্যমে রমজানের চাঁদ ওঠার সংবাদ প্রচারিত হয়। রমজানে তারা পরস্পরের মাঝে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে। সামগ্রিকভাবে রমজান উদযাপনের ব্যবস্থা করে। ইসলামিক সেন্টার অব ব্রাজিল রমজানের ইফতার, তারাবিসহ সামগ্রিক বিষয়ের আয়োজন করে থাকে। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায়, শায়খ আবদুর রহমান বাগদাদির ইমামতিতে ব্রাজিলের সালভাদির শহরে সর্বপ্রথম তারাবির জামাত অনুষ্ঠিত।

সিরিয়া ও লেবাননের কালচারের প্রাধান্য
রমজানে ব্রাজিলিয়ান মুসলিমদের আচার-আচরণেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যেমন—অন্য সময় হিজাব না পরলেও রমজানে মুসলিম নারীরা হিজাব পরিধান করে। কেউ কেউ আবার তা কয়েক মাস পর্যন্ত অব্যাহত রাখে। ইফতারের সময় তারা মসজিদ বা নামাজের স্থানের আশপাশের মুসলিম মিষ্টির দোকানে উপস্থিত হয়। ইফতারে অধিক পরিমাণ মিষ্টান্ন গ্রহণ করে। ব্রাজিলিয়ান মুসলিমদের বড় অংশ সিরিয়া ও লেবাননের অভিবাসী হওয়ায় কৃষ্টি-কালচার ও খাবারের ক্ষেত্রে এ দুই দেশের প্রাধান্য দেখা যায়। তারা সাধারণত সামাজিকভাবে ইফতারের আয়োজন করে। সেখানে সব শ্রেণির মুসলিম সপরিবারে অংশগ্রহণ করে। ব্রাজিলের মুসলিমরা গুরুত্বের সঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় করে। কিছু কিছু মসজিদে তারাবির নামাজে কোরআন খতম করা হয়।

ইসলামিক সেন্টার অব ব্রাজিলের প্রতিযোগিতা
কয়েক বছর যাবত মিসরের ধর্ম ও ওয়াকফ মন্ত্রণালয় রমজানে সেখানে নামাজ ও ইসলামি বিষয়ে পাঠদানের জন্য হাফেজ, কারি ও আলেমদের প্রেরণ করছে। তারাবির নামাজ শেষে দীর্ঘ মোনাজাত হয়। মোনাজাতে সারা বিশ্বের মুসলমানের জন্য দোয়া করা হয়। ব্রাজিলিয়ান মুসলিমরা রমজান মাসে কোরআন তেলাওয়াত ও সন্তানদের তা শিক্ষাদানের ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দেন। এ ছাড়া রমজানে সন্তানদের ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো শেখানোর ব্যবস্থা করেন। যেন ইসলামি বিশ্বাস ও চেতনার ওপর টিকে থাকে। ইসলামিক সেন্টার অব ব্রাজিল রমজানে হিফজুল কোরআন, কোরআন তেলাওয়াত, ইসলামিক পাঠ ও সাহিত্যবিষয়ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন।

১১ ঘণ্টার রোজা পালন
১১ ঘণ্টা রোজা রাখার পরও ব্রাজিলের মুসলিমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তারাবির নামাজ আদায় করেন। কিছু কিছু মসজিদে তারাবির নামাজে কোরআনে কারিম খতম করা হয়। ব্রাজিলের মুসলিমরা রমজানের রাতে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান করেন। রমজানের বিজোড় রাতে অনেকে সপরিবারে মসজিদে অবস্থান করেন। তারা ফজর পর্যন্ত নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত ও দোয়ায় অতিবাহিত করেন।

এসএইচ-১৩/৩০/২২ (ধর্ম ডেস্ক)