একটা মেয়ের দুইখান হাত বের হয়ে থাকাটা কোন অশ্লীলতা না

একটা মেয়ের দুইখান

কিছুদিন আগে একটা টিভি টকশোতে আমি একটা স্লিভলেস ব্লাউজের সাথে তাঁতের শাড়ি পরে গিয়েছিলাম। এমন না যে এ ধরণের টক শোতে কখনো কেউ স্লিভলেস পরে না। (এর আগে আমার সাথেই এক টকশোতে শম্পা রেজাকে পেয়েছিলাম, তিনি স্লিভলেস পরা ছিলেন।)

তো, সেই অনুষ্ঠানটি পরে টিভি চ্যানেলের ইউটিউবে আপ দেয়া হয়, সেই আপলোডেড লিংকের নিচে বাঙালি জাতির মহান ধ্বজভঙ্গ পুরুষেরা আমার স্লিভলেস নিয়া অন্তত ৫০টা কমেন্ট করেছে। আমারে বেশ্যা টেশ্যাও বলেছে। সাথে যে নারীরা ছিলেন, তাদের পরনে স্লিভলেস ছিল না, তবু তারাও বেশ্যা তকমা পাইসেন, যেহেতু আলোচনার বিষয়টা ছিল মি টু আন্দোলন।

আমি টিভি টক শোতে সাধারণত স্লিভলেস কখনোই পরি নাই। সেদিন মনে হইলো, এই শাড়িটার সাথে আমি সবসময় এই ব্লাউজখানাই পরি এবং সর্বত্রই আমি স্লিভলেসই যেহেতু পরি, তাহলে টিভি বলে স্লিভলেস এড়াবো ক্যান? স্লিভলেস কোন অশ্লীল পোশাক না। একটা মেয়ের দুইখান হাত বের হয়ে থাকাটা কোন অশ্লীলতা না।

তো আমি টিভিতে স্লিভলেস পরসি এবং কুৎসিত সব মন্তব্য পাইসি। আমি মন্তব্যগুলা তেমন মনোযোগ দিয়া আর পড়ি নাই। আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধবেরা আমারে দুই একটার কথা কইসেন।

এসব মন্তব্যে আমি অভ্যস্ত। লেখালেখির কারণে জঘণ্য ক্লেদাক্ত কথাবার্তা শুনে শুনে আমার কান মন মাথা সব এসবের সাথে অ্যাডজাস্ট করে ফেলসে। এগুলা দিয়া আমারে আর এক বিন্দু ধরাশায়ী করা যায় না।

আমি যখন দৈনিক পত্রিকায় কাজ করতাম, তখন আমার সিনিয়র এক সাংবাদিক আমার শার্ট জিনস পরা নিয়া বিরাট হুজ্জত করতেন। আমি কেন রাজনৈতিক দলের অফিসে শার্ট পিন্দা গেলাম, তাই নিয়া অফিসে আমার নামে নালিশ দিতেন। এরপর নানা জায়গায় পোশাক টোশাক নিয়া আমারে কম কথা শুনতে হয় নাই। এই পোশাক নিয়া আমি অনেকবার লিখসি। পোশাক দিয়া মেয়েদের চরিত্র যাচাইয়ের বিরুদ্ধে অসংখ্যবার বলসি।

আমার বন্ধুবান্ধবদের অনেকেও আমারে পোশাক নিয়া কথা শুনাইতো।

‘এত ডিপ নেকলাইন ক্যান পরছিস? ক্যান তোর ওড়না সরে যায়? ক্যান তো ব্রার স্টাইপ দেখা যায়?’

পোশাকের নিচে সেমিজ পরি নাই বলে বিরাট জাজমেন্টের শিকারও হইসি। আমারে উগ্র অসভ্য মেয়ে বলে তকমা দেয়া হইসে।

কোনকালেই এইগুলা গ্রাহ্য তো করিই নাই, বরং ক্রমাগত ভাংগে ভাংতেই চলতেসি। যেখানে যা করতে নিষেধ করসে, সেটাই করসি। যখন যা নিয়া সমালোচনা করসে, সেটাই প্রকাশ্যে করে রাখছি। যে পোশাক নিয়া খারাপ কথা বলছে, সেই পোশাকটাই পরছি। একাই পরছি। একাই চলছি।

আমি মনে করি, এই পোশাকের রাজনীতি ভাঙ্গাটা অনেক জরুরি। এই পোশাক দিয়া এরা আমাদের মনের উপ্রে যে আস্ত পাথরটা বসায়ে রাখে সেই পাথরটার অনেক ওজন। সেই পাথরটা সরাইতে না পারলে, নিজের হাত পাগুলাও ভারি হয়ে থাকে। সহজে পা চলে না।

তাই নারীর যুদ্ধে পোশাক যুদ্ধটাও গুরুত্বপূর্ণ। এই সমাজের বিরুদ্ধে নিজের ইচ্ছায় পোশাক পরার স্বাধীনতা প্রত্যেক নারীর আছে। এবং সেই পোশাক সে নিজেই ঠিক করে নেবে ও পরবে। এবং যা পরবে তা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে পরবে।

একবার যে মেয়ে পোশাকের রাজনীতির মুখে লাথি কষাতে পারে, সে আসলে এ দেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বন্ধ দরজায় প্রথম ধাক্কাটা মারে। এই ধাক্কাটার পর পরবর্তী ধাক্কাগুলো মারার জন্য মনটা তৈরি হয়ে যায়।

নষ্ট সমাজে লাথি কষানোর জন্য এদেশের সব মেয়ের আত্মবিশ্বাসী শক্তিশালী মন তৈরি হোক। শুভ সকাল।

মুনমুন শারমিন শামস, লেখিকা ও সংবাদকর্মী

আরএম-১৬/০৮/১২ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্যসূত্র: লেখিকার ফেসবুক থেকে)