বাঙালির চোখ মারা কালচার: সেদিন আর এদিন

বাঙালির চোখ মারা

কোচিং ক্লাসের অতি-দুর্লভ সহ-শিক্ষাক্রমে কেউ কারোকে চোখ মারলে কেস যে কতদূর গড়াত, তা আজকের বালক-বালিকাবৃন্দ অথবা স্নেহের হিজিবিজবিজ— কেউ অনুমানই করতে পারবে না।

সেদিন আর নেই যে চোখ মারা একটা গুরুতর সামাজিক অপরাধ বলে গণ্য হবে। এই তো বছর কুড়ি আগেও এই চোখ মারা নামক বিশেষ অভিব্যক্তিটি সম্পর্কে পারিবারিক এবং সামাজিক ট্যাবু কিছু কম ছিল না।

হিটলার-মার্কা বাপের কানে যদি কেউ একবার ঘুনাক্ষরেও তুলে দিত তাঁর ১৪ বছরের সুপুত্র বালকসুলভ চাপল্যেই একচোখ বুজে মুহূর্তকাল কাটিয়েছে, তাহলেই আর রক্ষে থাকত না। ক্যালানির নাম ধনঞ্জয়। মা-পিসি-শিবুদা— কেউই সেই মহাপ্রলয় রোধ করতে পারতেন না।

ক্লাসে যাদি কেউ চোখ মেরে ধরা পড়ত, তারও ভাগ্যে নাচত তাণ্ডব-ডম্বরু। ইন ফ্যাক্ট, বাঙালির সহবৎশিক্ষার একটা বড় পার্টই সেই সময়ে আবর্তিত হয়েছে চোখ নামক ইন্দ্রিয়টির উপরে সেন্সরশিপ চড়িয়ে।

অথচ আয়রনি এই, একেবারে খুদে কোলে-চড়াদের কাকা-পিসেরাই ‘চোখ মারা’ শেখাতেন। ন্যাড়ামাণিক, ফোকলাকুলের অধিকাংশের কাছেই ‘চোখ মারা’ ছিল আক্ষরিক অর্থেই চোখ মারা। খুদে আহাম্মকরা তাদের খুদে থাবা তুলে চোখের উপরে ঠাস করে চড়াত।

কিন্তু সেই অমল শৈশবের আক্ষরিক চেতনা বয়ঃসন্ধিতেই মিলিয়ে যেত। আর যাঁরা একদা তাকে চোখ মারার নির্দেশিকা প্রদান করেছিল, তারাই রক্তচক্ষু প্রদর্শন করে তাকে শাসনের উদুখলে বেঁধে নিয়ামের পরাকাষ্ঠা দেখাতে থাকে। সে সব কী ভয়ঙ্কর দিন! ‘নেপুদা লিপিদিকে চোখ মেরেছে’— এই জাতীয় স্টেটমেন্ট এককালে মফস্‌সল শহরে কী পরিমাণ উতাল-পাথাল ঘটাত, তা মনে করতে পারবেন একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শীরাই।

অথবা কোচিং ক্লাসের অতি-দুর্লভ সহ-শিক্ষাক্রমে কেউ কারোকে চোখ মারলে কেস যে কতদূর গড়াত, তা আজকের বালক-বালিকাবৃন্দ অথবা স্নেহের হিজিবিজবিজ— কেউ অনুমানই করতে পারবে না। সেই সব দিনে যাঁদের মুদ্রাদোষ ছিল চোখ মারা, তাঁদের নিয়ে চুটকির প্রবাহ বইত। পাত্রী দেখতে গিয়ে পাত্রের জ্যাঠা পাত্রীর মা-কে চোখ মেরে বসেছেন-জাতীয় ‘খবর’-ও দেদার পাওয়া যেত।

এহেন চোখ মারা-কে জলভাত করে দেয় হিন্দি ছবি। ‘আঁখ মারে’-জাতীয় গান মাইকে মাইকে ভাইরাল হয়ে গেলে নীতিশাসনও শিথিল হতে শুরু করে। আর তদ্দিনে অভিভাবকত্বে উন্নীত হয়েছেন তাঁরা, যাঁরা একদা চোখ মেরে বিরাট বিপাকে পড়েছিলেন বয়ঃসন্ধিতে। ক্রমাগত উইঙ্কিং উপচে ওঠে বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে।

কে কার কড়ি ধরে তখন! ইস্কুলে টিচার পড়াতে পড়াতে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে চোখ মারেন। শ্বশুরমশাই জামাইকে চোখ মেরে ইশারা করেন শাশুড়ির কাছে যৌথ মাল খাওয়ার গপ্পো চেপে যেতে। শাশুড়ি বৌমাকে চোখ মেরে পিএনপিসিতে রাশ টানেন। সে শুধু চোখের দিন, সে লগন চোখ মারিবার!

কিন্তু তেমনটাই বা রইল কই! পুরো ব্যাপারটাকেই ঘোটালা করে দিল নেট-কালচার আর সোশ্যাল মিডিয়া। ইমোজি-র বিন্যাসে ভার্চুয়াল চোখ মারা এখন অহরহ। কেউই কেয়ার করেন না এসব। কথায় কথায় খিচিক খিচিক। সারাদিনে বাঙালির হাতে ঠিক কী পরিমাণ ইমোজি চোখ মারে, তার হিসেব নিলে মহাভারত হয়ে যাবে। কিন্তু এই যে সকলি গরল ভেল-এর প্যাটার্নে চোখ মারা-র মতো একটা ভাইটাল ব্যাপার পুরো মায়া হয়ে গেল, সে খবর কি তরুণ প্রজন্ম রাখেন?

আরএম-১৫/১৬/০২ (লাইফস্টাইল ডেস্ক)