করোনাভাইরাস নিয়ে প্রচলিত প্রশ্নের উত্তর

কীভাবে ছড়ায়? নিজ বুদ্ধিতে ওষুধ খাওয়া কতটা মারাত্মক? ভালো হওয়ার পর আবারও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কিনা? এর বহু প্রশ্ন ঘুরে বেড়াছে মানুষের মনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আর সেসব প্রশ্নে উত্তর দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ অ্যালার্জি অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজ’য়ের পরিচালক এবং রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বিশেষজ্ঞ ড. অ্যান্থনি ফাউচি।

তিনি বহুদিন ধরে সংক্রামক রোগ নিয়ে কাজ করছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টদের পরামর্শক হিসেবে কাজ করা ছাড়াও পৃথিবীতে সার্স, ইবোলা, এইচআইভি, জিকা বা মহামারী বিষয়ে যত ঘটনা ঘটেছে সবগুলোতেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এই চিকিৎসক।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ‘দি ডেইলি শো’র অনলাইন ভার্সনে করোনাভাইরাস নিয়ে তার দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখানে আলোকপাত করা হল।

অন্যান্য ভাইরাস থেকে করোনাভাইরাসে তফাৎ কী?

ড. ফাউচি: অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, সংক্রামক রোগ সম্পর্কে কোন পরিস্থিতি নিয়ে আপনি সবচাইতে বেশি আতঙ্কিত? আমার উত্তর ছিল, শ্বাসতন্ত্রের মাধ্যমে সংক্রমিত হয় এমন রোগ, যা সহজেই মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে যেতে পারে এবং যার মৃত্যু হার অনেক বেশি। পৃথিবীতে অসংখ্য রোগ আছে, যার সবই কমবেশি ভয়ঙ্কর। ইবোলাও ভয়ঙ্কর ছিল। তবে তা ছড়ানোর একমাত্র পথ ছিল আক্রান্ত ব্যক্তির খুব কাছাকাছি যাওয়া, সেটাও আবার আক্রান্ত ব্যক্তি প্রচণ্ড অসুস্থ হলেই তা সম্ভব ছিল।

করোনাভাইরাস অনেকাংশে ইনফ্লুয়েঞ্জা’র মতো, আবার পার্থক্য আছে অনেকটা। করোনাভাইরাস ছড়াতে পারে খুব সহজেই, আপনার আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ না থাকলেও আপনার মাধ্যমে তা ছড়াতে পারে। করোনাভাইরাসের আরেকটি দিক যার সম্মুখীন আমরা আগে কখনই হয়নি তা হল এর মৃত্যুহার। যে মৌসুমি সর্দিজ্বরে আমরা প্রায়শই আক্রান্ত হই তার মৃত্যুহার ০.১ শতাংশ, যা শতাংশের হিসেবে সামান্য মনে হলেও পৃথিবীর জনসংখ্যার হিসেবে কিন্তু অসংখ্য লাশ এবং তার সঙ্গে আমরা মানিয়ে নিয়েছি। করোনাভাইরাসের মৃত্যুহার এর ১০গুন। যা খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে এবং জনগোষ্ঠীর একটি নির্দিষ্ট অংশের জন্য ভয়ঙ্কর মাত্রায় মারাত্বক। এই বিশেষ অংশ হল বৃদ্ধ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত মানুষ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনাভাইরাস নিয়ে প্রচুর মাতামাতি হচ্ছে। প্রত্যেকেরই মতামত আছে, যা ভুল ও সঠিক তথ্যের মিশ্রণ। এই অসংখ্য মতামত মানুষের মাঝে আতঙ্ক বাড়াচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে জানতে চাই করোনাভাইরাস ছড়ানোর মাধ্যম আর তা নিয়ে ছড়িয়ে থাকা ভুল তথ্যগুলো সম্পর্কে। মানুষ থেকে মানুষে কিভাবে ছড়ায় তা আমরা সবাই কমবেশি জানি। তবে মানুষ বাজার করতে গিয়ে আতঙ্কিত, লিফ্টে ওঠানামা নিয়ে আতঙ্কিত, বাইরে থেকে আসা পার্সেল নিয়ে আতঙ্কিত। এবিষয়গুলো নিয়ে আপনার মতামত কী?

ড. ফাউচি: মানুষ অনেক কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। প্রথমত যে ব্যাপারে সাবধান হতে হবে তা হল, কোনো মানুষের কাশি কিংবা হাঁচি হলেই তাকে আলাদা করে ফেলতে হবে। কারণ এই ভাইরাস ছড়ায় ‘ড্রপলেট’ বা তরল কণার মাধ্যমে। ভালোভাবে বোঝার জন্য অ্যারোসল কিংবা পারফিউমের কথা চিন্তার করুন। দুটোতেই তরল পদার্থ থাকে, কিন্তু তা স্প্রে করালে তরল কণা সঙ্গে সঙ্গেই নিচে পড়ে যায় না, বাতাসে কিছু সময় ভেসে বেড়ায়। একই ঘটনা ঘটে হাঁচি কাশির সময়ও, মুখ থেকে বেরিয়ে আসা লালা বাতাসে কিছুক্ষণ ভেসে থাকে। ওই ব্যক্তি যদি করোনাভাইরাসে আক্রন্ত হয় তবে তার লালায় সেই ভাইরাস থাকবে, যা একজন সুস্থ মানুষ শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে আক্রান্ত হবে।

তবে এটাই ছড়ানো প্রধান উপায় নয়। হাঁচি কিংবা কাশি দেওয়ার সময় প্রায় প্রতিটি মানুষ হাত দিয়ে মুখ ঢাকেন, যা সামাজিক শিষ্টাচারের অংশ। তো একজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী এই কাজটি করার পর তার হাতে করোনাভাইরাস চলে আসবে। এমতাবস্থায় সে যদি কোনো সুস্থ মানুষের সঙ্গে করমর্দন করেন তবে সুস্থ ব্যক্তির হাতেও ভাইরাস চলে গেল। আবার ওই অসুস্থ ব্যক্তি যা কিছু স্পর্শ করবে যেমন- অফিস কিংবা গৃহস্থালি যেকোনো কিছু, দরজার হাতল, লিফ্টের সুইচ ইত্যাদি অসংখ্য বস্তুর মাঝেও ভাইরাস ছড়িয়ে গেল।

যেকোনো শক্ত বস্তুর ওপর করোনাভাইরাস লম্বা সময় বেঁচে থাকতে পারে। এই বস্তুগুলো অন্য মানুষও স্পর্শ করবে এবং তাদের হাতেও ভাইরাস পৌঁছে যাবে। এবার এই মানুষগুলো তাদের নাক-মুখ-চেহারা স্পর্শ করলে ভাইরাস তাদের শ্বাসতন্ত্রে পৌঁছানো সুযোগ পেয়ে যাবে। তাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হল হাত পরিষ্কার করা, যত বেশি সম্ভব। বাজার করা, লিফ্টে ওঠানামা অন্যান সকল বিষয়েরও সমাধান ওই হাত ধোয়াই।

করোনাভাইরাসে বয়স্কদের বিপদ বেশি এই বিষয়টিকে অনেকেই ভুল দুষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। তরুণ ও মধ্যবয়স্করা ভাবছেন করোনাভাইরাস তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা। এব্যাপারে আপনি কি বলবেন?

ড. ফাউচি: দুটি বিষয় মাথায় নিতে হবে। প্রথমত, তরুণ বা মাঝবয়সি মানেই যে আপনি আক্রান্ত হবেন না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমরা ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সি অনেক রোগী পাচ্ছি, যাদের ‘ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট’য়ে নিতে হচ্ছে রোগের তীব্রতা সামাল দেওয়ার জন্য। এটা ঠিক যে তাদের মধ্যে অধিকাংশেরই হৃদরোগ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি রোগ আছে। তবে একেবারে সুস্থ তরুণ রোগীর সংখ্যাও নেহাত কম নয়। দ্বিতীয়ত, তরুণ হওয়ার সুবাদে হয়ত আপনি রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে বেঁচে গেলেন কিংবা ভোগান্তির মাত্রা হল খুবই সামান্য। কিন্তু ভাইরাস তো আপনার মাঝে আছে, যা আপনার কারণেই ছড়িয়ে যেতে পারে আপনার বৃদ্ধ বাবা-মা, পরিবারের অন্যান্য বৃদ্ধ সদস্যদের মাঝে, যা হতে পারে তাদের মৃত্যুর কারণ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা নিয়েও আলোচনা-সমালোচনা অন্ত নেই। এরমাঝেও অসংখ্য ভুল তথ্য ছড়িয়ে আছে। একটি উন্নত দেশের নেতৃস্থানীয় চিকিৎসা সেবক হিসেবে এর চিকিৎসা সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?

ড. ফাউচি: এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসের কোনো পরীক্ষীতভাবে প্রমাণীত চিকিৎসা নেই। অনেক পরীক্ষা-নিরিক্ষা চলছে বিভিন্ন দেশে এনিয়ে। ম্যালেরিয়ার ওষুধ মনে করা হচ্ছিল কার্যকরী, তবে তা প্রমাণীত হয়নি। ব্যাপারটা এমন যে মানুষ ভাবছে এই ওষুধ তাদের রোগের তীব্রতা কমাচ্ছে, কিন্তু তা পরীক্ষিতভাবে প্রমাণীত নয়। এটুকু জানা গেছে যে কোন ওষুধ সেবন নিরাপদ আর কোন ওষুধ বিপজ্জনক। তবে মনে রাখতে হবে সব ওষুধেরই কিছু না কিছু ক্ষতিকর দিক থাকে।

এখানে আরেকটি ভয়ঙ্কর দিকে আছে যা সাধারণ মানুষ হয়ত বুঝতে পারছেন না। করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচাবে কি-না তা নিশ্চিত না হয়েই একই ধরনের রোগের ওষুধ হয়ত আপনি সেবন করছেন। আতঙ্কের এই সময়ে আপনার মতো অনেকেই তা করতে পারে। ফলে ওই ওষুধের যোগান কমতে থাকবে এবং পরিস্থিতি এমন হতে পারে যে ওই ওষুধ আসলেই যে রোগের নিরাময়ের জন্য বানানো, সেই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিই তখন ওষুধ পাবে না।

বিভিন্ন দেশে ‘লকডাউন’, ‘কোয়ারেন্টিন’ ইত্যাদির মেয়াদ সম্পর্কে শোনা যাচ্ছে, যা ১৪ দিন, ১৫ দিন, ২১ দিন ইত্যাদি। ধারনা করা হচ্ছে এতদিন ঘরে থাকলেই করোনা অবস্থা স্বাভাবিক হবে। তো এই সময়টা আসলে কতটুকু যুক্তিযুক্ত আর পুরোপুরি ‘লকডাউন’ ও ‘কোয়ারেন্টিন’ করা না গেলে শুরু হওয়ার কোন সময়টা গণনা করার জন্য যুক্তিযুক্ত?

ড. ফাউচি: এই সময়সীমা যে করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি দেবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ঠিক কত দিনে তা হওয়া সম্ভব সেটাও বলে দেওয়া সম্ভব নয়। পুরো বিষয়টি নির্ভর করবে একটি দেশে ভাইরাস সংক্রমণের মাত্রা, শহরের প্রকৃতি, জনবহুলতার মাত্রা, জন সমাগমের মাত্রা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের উপর। আবার একটি দেশে অন্যান্য দেশ থেকে মানুষ আসা-যাওয়ার মাত্রাও বড় একটা ভূমিকা রাখে। নিউ ইয়র্কের অবস্থা প্রকৃত অর্থেই বেশ খারাপ, যার একটি কারণ হল দেশটি একটি অন্যতম ‘ট্রাভেল হাব’।

করোনাভাইরাসের আপাত অবস্থা নিয়ন্ত্রণে এলেও একটি বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়, আর তা হল পুনরায় সংক্রমণের শিকার হওয়া কিংবা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ‘ইমিউনিটি’ তৈরি হওয়া। অনেকেই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও রোগের উপসর্গ দেখা যায়নি, আবার অনেকেই সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে গেছেন। বিশ্বব্যাপী এদের সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। প্রশ্ন হল, আমরা কি জানি যে, একজন মানুষ করোনাভাইরাসের আক্রমণের পর সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছে সে-কি এই ভাইরাস থেকে ‘ইমিউন’ না কি তার আবারও সংক্রমণের শিকার হওয়ার আশঙ্কা আছে?

ড. ফাউচি: এটাও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয় কারণ সংক্রমণ পরবর্তী ভবিষ্যত নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ এখনই পাওয়া যায়নি। তবে ব্যক্তিগত ভাবে আমার বিশ্বাস, এই ভাইরাস যদি অন্য সব ভাইরাসের মতো হয়ে থাকে, তবে একবার এতে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়ার পর ওই আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে এই ভাইরাসকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা তৈরি হবে এবং পুনরায় সংক্রমিত হওয়া আশঙ্কা থাকবে না। তবে আবারও বলতে হয়, এটা শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলা সম্ভব নয়।