ফিট থাকতে চাইলে হাঁটুন

মন ভালো রাখতে হলে শরীর সুস্থ রাখতে হবে। আর শরীর সুস্থ বলতে শরীরকে ফিট রাখতে হবে। এছাড়া, নিজেকে সুন্দর রাখতে হলে শরীর ফিট রাখা খুবই দরকার। আর যারা নানা কারণে মোটা হয়ে যাচ্ছেন, তারা কী করবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না। এ ছাড়া জিম-ফিটনেস সেন্টারেও যেতে পারছেন না। তাদের জন্য একটাই সমাধান-হাঁটা। সে জন্য প্রতি দিনের রোজনামচায় হাঁটার সময় রাখুন। এ ছাড়া শরীরচর্চার সব উপায়ের মধ্যে হাঁটাকেই আপন করে নিন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিদিন ১০ থেকে ৩০ মিনিট পর্যন্ত হাঁটুন, সর্বদা ফিট থাকবেন ও সেইসঙ্গে ওজনও কমবে।

হজম উপকারী
যদি খাবারের পর হাঁটতে পারি তবে হজমশক্তি আরও ভালো হবে। হালকা হাঁটা আপনার খাবার হজম করে না, তবে হাঁটার পর পুষ্টিকর ডায়েট শরীরের সব অংশে যায়। রাতের খাওয়ার পর অল্প হাঁটলে আপনার পেপটিক আলসার, অন্ত্র সিন্ড্রোম (আইবিএস), ডাইভার্টিকুলার ডিজিজ, কোষ্ঠকাঠিন্য ও কোলোরেক্টাল ক্যানসারের মতো সমস্যা থেকে দূরে থাকবেন। এগুলো ছাড়াও হাঁটার মাধ্যমে বিপাক শক্তিশালী হয় যা দেহে শক্তি দেয়।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
গবেষণা অনুসারে, খাওয়ার পর হাঁটা চলা আপনাকে রক্তের শর্করার মাত্রা বাড়তে দেয় না। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে অতিরিক্ত ওজন। এ জাতীয় পরিস্থিতিতে যদি আপনি খাওয়ার পর হাঁটেন তবে ওজন হ্রাসের পাশাপাশি রক্তের শর্করাও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের ওপর একটি গবেষণা করা হয়েছিল, সেখানে জানা গিয়েছে, খাওয়ার পর ১০ মিনিট হাঁটলে রক্তে শর্করা হ্রাস করে। তাই বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি খাবারের পর ৩০ মিনিট হাঁটলে আরও ভালো ফল পাবেন।

হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস
শরীরচর্চা কয়েক দশক ধরে হৃদয়ের পক্ষে উপকারী বলে জানা গিয়েছে। এটি গবেষণায় প্রমাণিতও হয়েছে। মার্কিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও হিউম্যান সার্ভিসেস বিভাগ (ডিএইচএইচএস)-এর মতে, খাবারের পর ১০ মিনিট হাঁটলে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস পায়।

ওজন কমানো
প্রতিদিন খাবার খাওয়ার পর প্রায় ৩০ মিনিট হাঁটলে ওজন হ্রাস করতে সহায়তা করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, খাওয়ার পর হাঁটলে ১৫০ ক্যালরি পুড়ে যায় ও স্থূলত্ব হ্রাস করে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে ওজন কমাতে খাবার খাওয়ার পরে নিয়মিত জগিং করা উচিত। পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর ডায়েটেও মনোযোগ দেওয়া উচিত। যে, আপনার জাঙ্ক ও প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ এড়ানো উচিত।

হাড় শক্ত
একটি গবেষণা অনুসারে প্রতিদিন দশ হাজার পদক্ষেপ বা এক ঘণ্টা হাঁটলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে। এ ছাড়া হাঁটা হাড়কে শক্তিশালী করার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি হাড়ের ঘনত্ব বাড়িয়ে তোলে। সকালে হাঁটতে হাঁটতে সূর্যের রশ্মিও শরীরে পড়ে, যার ফলে শরীর ভিটামিন-ডি পায়।

হাঁটায় উপকারের শেষ নেই কারণ শারীরিক শক্তিবৃদ্ধি থেকে শুরু করে মন ভালো রাখার কাজও করতে পারে অল্প কিছু সময়ের হাঁটাহাঁটি। আর যারা হাঁটার একদমই সময় পান না, তারা দিনের একটা সময় বের করে অন্তত ১৫ মিনিট হাঁটেন, দেখবেন এতে দারুণ সব উপকার রয়েছে।

বাইরে ১৫ মিনিট হাঁটলেই মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা অবসাদ কেটে যাবে। অকারণের বিষাদ কেটে গেলেই দেখবেন একটা কিছু করার আগ্রহ আবার জাঁকিয়ে বসবে।

বিপাকক্রিয়া
নাইজেরিয়ান মেডিকেল জার্নালের প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে প্রতিদিন একনাগাড়ে ১৫ মিনিট হাঁটলেই হজমের সমস্যা প্রায় ৩০ শতাংশ দূর হয়।

ভালো ঘুম
দিনের একটা সময় খানিকটা দ্রুতগতিতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট হেঁটে দেখুন। রাত হলে ফোনের পর্দায় আর চোখ দুটি রাখতে ইচ্ছা করবে না। ঘুমে জড়িয়ে আসবেই।

মাটিতে পায়ের পাতার চাপে গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে স্পন্দন। যা কিনা ধমনিতেও প্রভাব ফেলে। রক্ত সঞ্চালন বাড়ে মস্তিষ্কে। এতে করে পরে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাওয়া বা কগনিটিভ রোগের হাত থেকে বেঁচে যাবেন।

পা ও কোমর ব্যথার মতো কিছু ব্যথা আছে শরীরে সারাক্ষণ লেগেই থাকে। দিনে নিয়ম করে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলে পরে আর পেইনকিলার খেতে হবে না। বিশেষ করে লোয়ার ব্যাক পেইনের রোগীদের জন্য হাঁটার বিকল্প নেই।

চোখের রেটিনার জন্যও হাটাহাটি বেশ উপকারী। রেটিনাল ডিজেনারেশনের ঝুঁকি কমায় হাঁটাহাঁটি। যারা নিয়মিত হাঁটেন, দেখা যায় বুড়ো হয়ে গেলেও তাদের চোখে চশমা পরতে হচ্ছে না।

অফিসে টানা বসে না থেকে কাজের মাঝখানে বিরতি নিয়ে একটু হাঁটুন ও পুরো শরীরকে প্রসারিত করার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে নিজের অফিসের ডেস্ক ছেড়ে অন্য কলিগদের ডেস্কে ঘুরে কথা বলুন। এতে করে অনেকটা রিলাক্সেশন হবে শরীরের। এভাবে প্রতিদিন চেষ্টা করুন আধা ঘণ্টা করে ব্রেক নিতে। রাতে খাওয়ার পর কিছুক্ষণ হাঁটতে পারেন। এতে ঘুমের সমস্যা হবে না। বয়স্ক ব্যক্তিদের শরীর সুস্থ রাখতে হাঁটাচলা করা জরুরি।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের হাঁটার গতি কমে আসে। তাদের দেহ ভঙ্গি ঠিক থাকে না। এমনকি কিছুক্ষণ হাঁটার পরই তারা তাল হারিয়ে যেতে শুরু করেন। এর পাশাপাশি হাড়ের রোগ, হৃদরোগ, হাঁপানি বা শরীরের কোনো অংশে ব্যথা থাকলে হাঁটাচলা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। তাই বয়স্ক ব্যক্তিদের হাঁটার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় নজরে রাখা দরকার।

স্ট্রেচিং করা
বার্ধক্যজনিত কারণে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন দেখা দেয়। এটি ব্যক্তির হাঁটার ধরন পাল্টে দেয়। হাঁটাচলাকে ব্যায়াম হিসাবে গণ্য করলে তার আগে স্ট্রেচিং করে নিতে পারেন। এতে সুফল পাওয়া যায়। কারেন্ট ট্রান্সলেশনাল জেরিয়াট্রিকস অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টাল জেরোন্টোলজি রিপোর্টস’-এ প্রকাশিত গবেষণার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, কিছু ব্যায়াম বয়স্ক ব্যক্তির হাঁটার ক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম। চেয়ারে ওঠা-বসা করা, পায়ের পাতার জোড়ের স্ট্রেচিং, অ্যারোবিকস কন্ডিশনিং ব্যায়াম অথবা শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে এমন ব্যায়াম কার্যকরী প্রমাণিত হতে পারে। হাঁটা শুরু করার আগে পিঠ, নিতম্ব, কোয়াড, হ্যামস্ট্রিংয়ের স্ট্রেচিং করে নিন। সব বয়সের ব্যক্তিদের জন্যই এগুলো জরুরি। তবে বৃদ্ধদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

গান শোনা
হাঁটার সময় গান শুনলে বয়স্করা বিশেষ উপকার পেতে পারেন বলে বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন। ‘জার্নাল অফ ফিজিওথেরাপিতে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, স্ট্রোক থেকে সেরে ওঠা রোগীরা যদি হাঁটার সময় গান শোনার অভ্যাস করেন, তবে তাদের হাঁটার গতি বাড়বে, প্রতি ধাপের দূরত্ব বাড়বে, শরীরের তাল বজায় রাখতেও সুবিধা হবে।

হাঁটার সঠিক ধরনের দিকে নজর রাখুন
বিশেষজ্ঞদের মতে, হাঁটার সময় ব্যক্তির মাথা সঠিক অবস্থানে রাখা উচিত। ঘাড়কে মেরুদণ্ডের একটি অংশ ভেবে নিতে হবে। এবার মনে করুন আপনি নিজের মেরুদণ্ডকে প্রসারিত করছেন। চোয়াল থাকবে মাটির সঙ্গে সমান্তরাল। কার্যকরী ভাবে হাঁটতে হলে পদক্ষেপের সময় পায়ের গোড়ালি সবার আগে মাটি স্পর্শ করবে, এরপর মাটি ছোঁবে পায়ের সামনের অংশ। আর পা তোলার সময় পায়ের বুড়ো আঙুল মাটিতে ধাক্কা দেবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে হাঁটার সময় হাতের সঠিক ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া দরকার। তাদের মতে, হাঁটার সময় হাত কনুই থেকে ভাঁজ হয়ে থাকবে। ছোট ছোট পদক্ষেপ করতে হবে কিন্তু পা চলবে দ্রুত। ফলে গতি বাড়ার পাশাপাশি শরীরের ভারসাম্যও বজায় থাকবে বলে মনে করেন তারা।

বার্ধক্যজনিত কারণে হাঁটতে গিয়ে যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই বয়স্করা হাঁটতে গেলে সঙ্গে অবশ্যই মোবাইল রাখবেন। শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি দুর্বল হলে রাতে হাঁটতে যাওয়ার প্রবণতা ত্যাগ করুন। নিজের রোগ সম্পর্কে সচেতন থাকুন ও জরুরি সময়ে যোগাযোগ করবেন এমন ব্যক্তির ফোন নম্বর, ঠিকানা ইত্যাদি সঙ্গে রাখুন।

আবার আবহাওয়াও সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। গ্রীষ্মকালে বয়স্কদের জন্য ব্যায়াম করা বেশি কষ্টকর। সে ক্ষেত্রে হাঁটার জন্য শীত বা গরম কম এমন স্থান বাছাই করুন।

হাঁটার সময় পায়ে সাপোর্ট দিতে পারে এমন জুতা বাছাই করুন। ঢিলেঢালা জুতা পরে হাঁটলে গতি কমে আসে। আবার অতিরিক্ত নরম জুতাও হাঁটার জন্য উপযোগী নয়। এর পরিবর্তে শক্ত জুতা পরে হাঁটুন। ফলে ব্যথাও কম হবে।

হাঁটার সময় ব্যাগ বা ভারী কোনো বস্তু সঙ্গে রাখবেন না। ব্যাগ নিতে হলে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের পরিবর্তে পিঠে, দুই কাঁধে রাখা যায় এমন ব্যাগ ব্যবহার করুন। আবার হাতে পানির বোতল না-রাখাও বুদ্ধিমানের পরিচয়। তা না-হলে এ অসম ওজন শরীরের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।

এসএ-০৪/০১/২৩ (লাইফ স্টাইল ডেস্ক)