“কেন আমার স্বামীর মতো একজন নির্দোষ মানুষকে এভাবে হত্যা করা হলো? এখনো বিচার পাইনি, মামলাও করতে পারিনি। সব সময়ই হুমকির মুখে আছি আমরা।”
বলছিলেন আয়েশা বেগম – এ বছরই কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর ও স্থানীয় যুবলীগ নেতা মো. একরামুল হকের স্ত্রী ।
এ বছর অক্টোবর পর্যন্ত মাদক-বিরোধী অভিযানে নিহত চার শতাধিক লোকের একজন এই একরামুল হক।
শত শত মৃত্যুর মধ্যেও ওই ঘটনাটি বিশেষ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে – কারণ সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি অডিও টেপ, যাতে একরামুল হককে তার মেয়ের সাথে কথা বলতে শোনা যায়, এর পর শোনা যায় গুলির শব্দ, আর্তচিৎকার এবং ফোনের একপাশ থেকে মি. হকের স্ত্রীর কান্না, সব মিলিয়ে এক ভয়াবহ পরিবেশের চিত্র ফুটে ওঠে ওই অডিওতে।
এটি প্রকাশ পাওয়ার পর সামাজিক নেটওয়ার্কে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। আয়েশা বেগম সোমবার জানান, তিনি এখনো বিচার চেয়ে একটি মামলাও করতে পারেন নি।
তিনি জানান, কক্সবাজার থানায় মামলা করার চেষ্টা করেছেন তার পরিবারের অন্যেরা, কিন্তু মামলা করতে দেয়া হয়নি বরং তাদের নানা হুমকির শিকার হতে হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম ১০ মাসে ৪৩৭ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
দেশ জুড়ে ‘মাদকবিরোধী অভিযান’ চলার সময় গত ২৬শে মে গভীর রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মিঠাপানির ছড়া এলাকায় র্যাবের সঙ্গে এক ‘বন্দুকযুদ্ধে” একরামুল হক নিহত হন। র্যাব বলেছিল, সেখান থেকে কিছু অস্ত্র ও ১০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১০/১১ সালে যে মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা করেছিল তাতে একরামুল হকের নাম ছিল বলে র্যাব দাবি করেছে। তবে টেকনাফ থানার ওসি বলেছিলেন, একরামুল হকের বিরুদ্ধে ইয়াবাসংক্রান্ত কোনো মামলা নেই। তার স্ত্রী আয়েশা বেগম বলছেন, তার স্বামী সম্পূর্ণ নির্দোষ।
আয়েশা বেগম বলছিলেন, তিনি চান তার অভিযোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে, কিন্তু সরকারের নানা পর্যায় থেকে আশ্বাস পেলেও এখনো প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পাননি তিনি।
আয়েশা বেগম বলছিলেন, তার এবং পরিবারের অন্যদের ওপর নানা হুমকি এসেছে, নানা ভাবে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু তিনি ভীত নন।
“আমার মৃত্যুর কোন ভয় নেই । আমরা আমার স্বামীর সাথে মারা গেছি” – বলেন তিনি। তিনি আরো জানান তার দুই মেয়ে এখনো অসুস্থ, এখনো তারা পিতার মুত্যুর আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারে নি।
মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে সোমবার প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে আসক বলেছে, মাদকের বিরুদ্ধে সরকারের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির অংশ হিসেবে সেই অভিযান চালানো হয়। সারা বাংলাদেশে চালানো অভিযানের সময় ১৫ মে থেকে ৩১শে অক্টোবর পর্যন্ত ২৭৬ জন নিহত হন র্যাব-পুলিশের সাথে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’।
এ বছর বাংলাদেশে প্রথম ১০ মাসে সব মিলিয়ে ৪৩৭ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এছাড়া এই সময়ের মধ্যে গুমের শিকার হয়েছেন ২৬ জন।
গত বছর এই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ছিল ১২৬। অর্থাৎ চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসেই এই সংখ্যা আগের বছরের চেয়ে সাড়ে তিন গুণ ছাড়িয়ে গেছে।
এর আগে ২০০৭ সালে সবচেয়ে বেশি বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড রেকর্ড করা হয়েছিল – ৩৫৪ জন।
বাংলাদেশের এবং দেশের বাইরের মানবাধিকার সংগঠনগুলো এসব ঘটনার তীব্র সমালোচনা করেছে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু এবং অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জড়িত থাকার অভিযোগের ব্যাখ্যা চেয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠালেও বেশিরভাগের কোন উত্তর মেলেনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ঘটনার পর বলেছিলেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিবর্ষণের অন্যান্য ঘটনা যেভাবে তদন্ত হয়, এটিও সেভাবে তদন্ত হবে।
এসএইচ-০৮/১১/১২ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্য সূত্র : বিবিসি)