কৌশল্যার প্রথম স্বামী তার বাবার ষড়যন্ত্রে নিহত হন, কারণ ভিন্ন গোত্রের হওয়ার কারণে কৌশল্যার বাবা তার স্বামীকে জামাতা হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন।
২১ বছর বয়সী কৌশল্যা নিজ বাবার বিরুদ্ধে এই হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তোলেন।
সম্প্রতি কৌশল্যা আবার বিয়ে করেছেন ঠিকই তবে তিনি এবারও তার এই দ্বিতীয় স্বামীর প্রাণনাশের শঙ্কায় আছেন বলে বিবিসিকে জানান।
এমন হুমকির মুখে তিনি এখন পুলিশ সুরক্ষা চাইছেন।
কৌশল্যার প্রথম স্বামীকে হত্যার পুরো ঘটনা সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল।
সেখানে দেখা যায় যে, বৃহস্পতিবারের মতো ব্যস্ত দিনে কৌশল্যা ও তার স্বামী এক বিশাল মার্কেটে ঘুরে বেড়াচ্ছিলের।
এমন সময় পাঁচ ব্যক্তি দুটি মোটরসাইকেলে করে তাদের সামনে আসে। তাদের হাতে ছিল বিশালাকার ধারালো অস্ত্র।
এ সময় তারা কৌশল্যার স্বামী শংকরের ওপর এলোপাথাড়ি ছুরিকাঘাত করতে থাকে।
এসময় কৌশল্যার বাধা দিতে গেলে তার মাথাতেও কোপ বসিয়ে যুবকেরা পালিয়ে যায়।
পুরো ঘটনাটি ঘটেছে মাত্র ৩৬ সেকেন্ডে এবং প্রতিটি সেকেন্ডে তারা ওই দুজনের ওপর নির্মমভাবে আঘাত করে গিয়েছে।
পরে স্থানীয়রা দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও পথেই মারা যান শংকর।
গুরুতর আহত কৌশল্যা প্রাণে বাঁচলেও তার মাথায় ৩৬টা সেলাই নিতে হয়।
তাদের দুজনকে আক্রমণ করা হয়েছিল কারণ কৌসল্যা সামাজিক প্রথা ভেঙ্গে তার চেয়ে নিম্নবর্ণের এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেছিলেন।
আর যিনি এই হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন বরং কৌশল্যার বাবা।
কৌশল্যা বেঁচে ফিরে তার বাবাকে জেলে পাঠান।
প্রায় তিন বছর আগে ঘটে যাওয়া এই হামলার ঘটনায় কৌশল্যা যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলের তার কারণে এখন দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে কৌশল্যাকে প্রতিবাদ ও সাহসের প্রতীক হিসাবে দেখা হয়।
কৌশল্যা হাসপাতালের বিছানা থেকে পুলিশকে বলেছিলেন যে তার বাবা-মা এই খুনের জন্য দায়ী।
পরে পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে যে এই হত্যাকাণ্ডের আদেশ দেয়ার পাশাপাশি অর্থায়ন করেছিলেন কৌশল্যারই বাবা।
যিনি দলিত সম্প্রদায়ের ব্যক্তির সাথে তার মেয়ের বিয়ে করার সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
ভারতে দলিত সম্প্রদায় বলতে “অস্পৃশ্য” জাতিকে বোঝায়- যাদেরকে সেখানকার সমাজে সবচেয়ে নিম্নবর্ণ হিসেবে ধরা হয়। এবং এই দলিতরা শত শত বছর ধরে দেশটিতে সমাজ বর্জিত হয়ে আছে।
অন্যদিকে কৌশল্যা মূলত রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ভূমি মালিকানাধীন জাতি-থেভার্সের সদস্য।
হিন্দু বর্ণের অনুক্রম অনুযায়ী থেভার্সরা সর্বোচ্চ গোত্র না হলেও তাদের অবস্থান দলিতদের উপরে।
কৌশল্যা এক দলিত সম্প্রদায়ের ব্যক্তিকে বিয়ে করায়, একে গোটা থেভার্স সম্প্রদায়ের জন্য লজ্জাজনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
যার ফলশ্রুতিতে কৌসল্যার বাবা ভাড়াটি খুনি দিয়ে এই হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেন।
এই ভয়াবহ হামলা এবং পরবর্তীতে দু:সহ যন্ত্রণা কৌশল্যার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি তার স্বামীর হত্যার বিচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
এজন্য তিনি নিজ বাবা-মায়েদের জামিন আবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে কয়েকবার হাজিরা দেন।
অবশেষে স্থানীয় আদালত তার বাবা চিন্নাস্বামীসহ ছয়জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। পরে আপিলে তার মাসহ দুইজনকে খালাস দেয়া হয়।
ভারতীয় জনসংখ্যার প্রায় এক ভাগ পঞ্চমাংশ এই দলিত সম্প্রদায়ের। অথচ তারা ব্যাপকভাবে দারিদ্র্য ও বৈষম্যের শিকার।
তাদের রক্ষায় আইন থাকা সত্ত্বেও, সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী কেবলমাত্র ২০১৬ সালেই নিম্নবর্ণের ওপর চল্লিশ হাজারের বেশি অপরাধের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
শত শত বছর ধরে দলিতদের মন্দির সেইসঙ্গে কতিপয় আবাসিক এলাকায় প্রবেশ করার অনুমতি দেয়া হয়না। এমনকি গ্রামে সবার ব্যবহারের জন্য কুয়া থেকেও পানি তুলতে দেয়া হয়না তাদের।
এমনকি আজও, তাদেরকে এমন সব কাজ করতে বাধ্য হয় যা কেউ করতে চায় না, যেমন ল্যাট্রিন থেকে মানুষের বর্জ্য অপসারণ এবং মৃত প্রাণীদের ব্যবস্থাপনা করা।
তবে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের জন্য আজকাল দলিতরাও শিক্ষা এবং চাকরির সুযোগ পাচ্ছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি-রামনাথ কোভিন্দ দলিত সম্প্রদায় থেকে এসেছেন।
অতীতে দলিত ও উচ্চশ্রেণীর মধ্যে জমি, মজুরি, পানি, আবাসন এবং অস্পৃশ্যতার অভ্যাসের বিরুদ্ধে লড়াই চলতেই থাকতো।
আর এখন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ে হয়। কিন্তু, কৌশল্যার প্রথম বিয়ে সহিংসতার জন্ম দিয়েছিল।
ভারতীয় সমাজে, দৈনন্দিন জীবনে “গোত্র বা সম্প্রদায়” একটি প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করে।
কি খেতে হবে, কোথায় খেতে হবে এবং কাদের সঙ্গে খেতে হবে, এমন পার্থিব বিষয় থেকে শুরু করে জীবন ঘনিষ্ঠ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, যেমন কাকে বিয়ে করতে হবে বা কোথায় বাড়ি কিনতে হবে, এই বিষয়গুলোর ওপরে গোত্রের প্রভাবকে অনেকেই উপেক্ষা করতে পারে না।
সম্প্রদায় পদ্ধতি হিন্দুদের চারটি প্রধান ভাগে ভাগ করে – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈষ্য এবং শূদ্র।
এই অনুক্রমে আধিপত্যের শীর্ষে রয়েছেন ব্রাহ্মণরা -যারা প্রধানত শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী হয়ে থাকেন। তারা হিন্দু ত্রৈমাসিকের প্রথম দেবতা- ব্রহ্মার মাথা থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়।
তারপর আসেন ক্ষত্রিয়রা – যারা মূলত যোদ্ধা ও শাসক হয়ে থাকেন – তারা এসেছেন ব্রহ্মার অস্ত্র থেকে।
তৃতীয় স্থানটি বৈশ্যদের। যারা কিনা ব্যবসায়ীরা। এরা ব্রহ্মার উরু থেকে তৈরি হয়েছিল।
এবং ব্রহ্মার শরীরের নীচের দিকে অর্থাৎ পায়ের কাছে অবস্থান শূদ্রদের। যারা ভৃত্যের কাজ করে থাকে।
হিন্দুদের এই জাতি ব্যবস্থার বাইরে রয়েছে দলিত বা অস্পৃশ্যরা।
এই প্রধান চারটি সম্প্রদায়কে বিভিন্ন পেশার ভিত্তিতে আরও তিন হাজার সম্প্রদায়ে এবং সেগুলোকে আরও পঁচিশ হাজার উপ-সম্প্রদায়ে ভাগ করা হয়েছে।
বৈষ্য সম্প্রদায়ে আধিপত্য বিস্তার করছে ভারতের অতি ধনাঢ্য ব্যক্তিরা। যেখানে ব্রাহ্মণরা আধিপত্য বিস্তার করে সিভিল সার্ভিস, বিচারব্যবস্থা এবং বুমিং প্রযুক্তি খাতে।
প্রথম স্বামী হারানোর পর কৌসল্যা তার মানসিক চাপ ও বিষাদকে কাটিয়ে ওঠার জন্য ছোট তবলার মতো বাদ্যযন্ত্র- “পারাই” বাজানো শিখতে শুরু করেন।
এই বাদ্যযন্ত্রটি দলিত সম্প্রদায়ের পারিয়াহর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
পারাই শেখার সময় ওই একাডেমীর পরিচালক শক্তির সঙ্গে কৌসল্যার পরিচয় হয়।
পরে কৌশল্যা শক্তিকে বিয়ে করেন এবং তার এই নতুন স্বামীও একটি ভিন্ন গোত্রের।
দলিত সম্প্রদায়ের একজনকে বিয়ে করার পর থেকে কৌশল্যা নিজ সম্প্রদায়ের লোকজনের থেকে প্রাণনাশের হুমকি পেয়ে আসছেন।
তাদের মতে, কৌশল্যা এই বিয়ের মাধ্যমে গোটা সম্প্রদায়ের জন্য লজ্জা বয়ে এনেছে।
বর্ণবাদ বিরোধী এই ২১ বছর বয়সী তরুণী বলেন, “অনেক লোক আমাদের আশীর্বাদ করছে, আবার অনেক অপরিচিত লোকজন আমাদের হুমকি দিচ্ছে। এ কারণে আমাদের পরিবারের সদস্যরা এবং বন্ধুরা খুব চিন্তিত।”
তিনি বলেন, “আমরা সাধারণত সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমের লেখাগুলো এড়িয়ে চলি। কিন্তু অনেকেই আমাদের ফোনে হুমকি দিচ্ছে। কেউ কেউ বিদেশ থেকেও ফোন করে নোংরা ভাষায় গালিগালাজ করে।”
এ অবস্থায় নিজের এবং নতুন স্বামীর জীবন রক্ষায় পুলিশ সুরক্ষা চাইকে বাধ্য হয়েছেন কৌশল্যা।
গত দুই বছর ধরে এক নিরস্ত্র নারী কনস্টেবল কৌশল্যার সুরক্ষায় নিয়োজিত আছেন।
কিন্তু কৌশল্যার নতুন বিয়ের দিন পরে সেই কনস্টেবলকে আর দেখা যায়নি। এ অবস্থায় নবদম্পতির অভিযোগ যে তারা চতুর্দিক থেকে চাপের মুখে আছে।
কৌশল্যা জানান যে তিনি এখনও সেই সুরক্ষা পাওয়ার দাবি পুনরুদ্ধার করতে পারেননি। তবে পুলিশ তার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
কৌশল্যা জানান, তার মতো যারা নিজ গোত্রের বাইরে বিয়ে করে তাদের সুরক্ষায় বিশেষ আইন প্রণয়নের জন্য তিনি যে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন সেটাকে কোন হুমকি ও ভীতি দেখিয়ে বন্ধ করা যাবে না।
“আমার বক্তৃতা শোনার পর অনেকেই আমাকে বলছে যে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে বিয়ের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গিয়েছে।”
“আমি নিজেকে পরিবর্তনের উদ্দীপক হিসেবে দেখতে চাই।”
এসএইচ-০৭/২৩/১৮ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্য সূত্র : বিবিসি)