নির্বাচনে ভরাডুবিতে বিএনপি’র তৃণমুলে হতাশা

নির্বাচনে ভরাডুবির পর বিরোধীদল বিএনপি’র তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঝে নতুন করে হতাশা এবং অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

দলটির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের অনেকে বলেছেন, সরকার কারচুপির করে একচেটিয়া জয় পেয়েছে বলে তারা বিশ্বাস করেন। কিন্তু তারপরও বিএনপির এই ফলাফল বিপর্যয় তাদের জন্য বড় আঘাত।

তারা মনে করেন, পরিস্থিতির নেতিবাচক প্রভাব তাদের দলের মাঠ পর্যায়ে বেশি পড়বে।

তবে দলটির সিনিয়র নেতাদের অনেকে বলেছেন, তাদের হতাশা কাটাতে এখন দল গোছানোর বিষয়ে বেশি নজর দেবেন।

দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া জেলে থাকায় তাঁর অনুপস্থিতিতেই বিএনপি এবার নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।

দলটি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে এই নির্বাচনে অংশ নেয়ায় তৃণমুলের নেতাকর্মিরা তাদের জন্য একটা অনুকুল পরিস্থিতির স্বপ্ন দেখেছিলেন।

কিন্তু শেষপর্যন্ত ফলাফল বিপর্যয়কে তারা এখন দলের জন্য বড় সংকট হিসেবে দেখছেন।

দক্ষিণ পশ্চিমের জেলা যশোরে বিএনপির ভাল অবস্থান ছিল। সেখান থেকে দলটির একজন নেতা মকবুল হোসেন বলছিলেন, এবার তাদের মাঝে অনিশ্চয়তা বেশি কাজ করছে।

“আমরা আশা করেছিলাম, এই নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসুক আর না আসুক, অন্তত প্রধান বিরোধীদল হিসেবে থাকবে। এবং গণতান্ত্রিকভাবে রাজনীতি করতে পারবো। কিন্তু যেহেতু সম্মানজনক আসন পায় নাই। সেকারণে তৃণমুলে দীর্ঘমেয়াদী বিরোধীদল বা সংগ্রাম করার ক্ষেত্রে কর্মিদের মাঝে চরম হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। এটা সংগঠনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে বা সংগঠন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

“এই ‘বিপর্যয় সবচেয়ে বড় সংকট”
একযুগ ধরে বিএনপি ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। এই পুরো সময়টায় দলটিকে বিপর্যয়ের মধ্যে থেকে চলতে হয়েছে।

সর্বশেষ খালেদা জিয়ার জেলে যাওয়ার বিষয়টি দলটিকে বড় সংকটে ফেলেছিল।

তৃণমুলের নেতাকর্মিরা এসব পরিস্থিতির শিকার বেশি হয়েছেন বলে তারা মনে করেন। তাদের একটা বড় অংশ মামলার কারণে এলাকার বাইরেই পালিয়ে থেকেছেন। সেখানে আরও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।

খুলনা থেকে বিএনপির নেতা নুরুল ইসলাম মঞ্জু বলেছেন, এখনকার বিপর্যয়কে তারা তাদের জন্য সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে দেখছেন।

“১২ বছরে এবারের আঘাতটা কিন্তু আরও বড় ধরণের,” তিনি বলছেন, “এবারের নির্বাচনে বিএনপি একেবারে অগোছালো ছিল। বিএনপি নির্বাচনে যাবে কিনা, নেতাকর্মিরা সেটা জানতো না, অন্ধকারে ছিল। এবং কর্মিদের তৈরি করে মাঠে নামানো, সে ধরণের কোন কিছু ছিল না।”

“হঠাৎ করে নির্বাচনে যাওয়া। তারপরও দল যেহেতু নতুন একটা ফ্রন্ট গঠন করেছে, নেতাকর্মিরা মনে করেছে, হয়তো জোটগতভাবে এগুতে পারবে এবং সরকার হয়তো সুষ্ঠু নির্বাচন দেবে। এর কোনটাই না হওয়ায় নেতাকর্মিরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।”

আরও কয়েকটি জেলায় বিএনপির নেতা কর্মিদের সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, তারা বিশ্বাস করেন যে, ব্যাপক কারচুপি করে সরকার বিএনপিকে মাত্র পাঁচটি আসন দিয়েছে। এরপরও মাঠপর্যায়ের নেতারা তাদের কর্মিদের নিরাপত্তার বিষয়সহ অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছেন।

উত্তরের রাজশাহী থেকে বিএনপির একজন নেতা শফিকুল আলম বলছিলেন, নেতাকর্মিরা এলাকায় টিকে থাকতে পারবেন কিনা, এমন প্রশ্নেরও মুখোমুখি হচ্ছেন তারা।

“এই নির্বাচনে প্রথমে ভেবেছিলাম, ক্ষমতায় যাব। প্রচারণা শুরুর পর আমাদের ওপর ওপর সরকারের সহিংস হামলার ঘটনা এবং তাদের একতরফা প্রচারণায় মনে হয়েছিল, বিরোধীদলে যাব।”

“কিন্তু একেবারে পাঁচ সাতটি আসনে নামিয়ে আনায় আমাদের কর্মিরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। তাদের অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছি আমরা।”

কীভাবে সামনে এগিয়ে যাবে বিএনপি?
দল কি করবে বা কিভাবে এগুবে এসব প্রশ্নও উঠছে বিএনপিতে। নুরুল ইসলাম মঞ্জু মনে করেন, তাদের দলের স্বকীয়তা বজায় রাখার প্রশ্নেও ঘাটতি হয়েছে।

“গত দু’দিন ধরে মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে, বিএনপিকে নিজস্ব জায়গা থেকে ঘর গুছিয়ে, দল গুছিয়ে নিজের সত্তায় ফিরে আসতে হবে। জোটবদ্ধ রাজনীতি করলেও বিএনপির নিজস্ব একটা সত্তা আছে এবং ছিল। সেখানে বিএনপিকে আসতে হবে।”

নির্বাচনের ফলাফলে বিএনপির সিনিয়র নেতারাও হতবাক হয়েছেন। তাদের মধ্যেও হতাশা তৈরি হয়েছে।

দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমেদ বলেছেন, দলে হতাশা কাটিয়ে ওঠার বিষয়ে তারা বেশি নজর দিচ্ছেন।

তিনি বলছেন, “আমাদের জন্যতো স্বাভাবিকভাবে এটা একটা সেটব্যাক বলা যেতে পারে। এখন আমাদের সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে।”

“যদি আমরা টিকে থাকতে চাই, আমাদের যারা এই সময়ে সংগঠনের সাথে ছিল, যারা এই সময়ে নির্বাচনের প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল, তাদেরকে আমাদের সামনের দিকে নিয়ে আসতে হবে।আর পালিয়ে বেরিয়েছে, আমাদের এড়িয়ে গেছে, তাদের একটু দূরে রেখে সংগঠন গোছাতে হবে।”

বিএনপির নেতারা এটাও উল্লেখ করেছেন, তারা দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখে এগুতে চান।

সিনিয়র সাংবাদিক রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, এই নির্বাচনের ফলাফল বিএনপির নেতা-কর্মি এবং সমর্থকদের মধ্যেও অনেক বড় হতাশা সৃষ্টি করেছে।

“বিএনপি তো আসলে সংকটের মধ্য দিয়ে অনেক দিন ধরেই যাচ্ছে। তাদের নেতৃত্বের সংকট, কি ধরণের কৌশল হবে রজনীতিতে, তার সংকট ছিল। এর মধ্যে নির্বাচনে যে পাফরমেন্স এটার পেছনে অনেক কারণ আছে, কিন্তু এটাতো হতাশা সৃষ্টি করেছে।”

“হতাশা সৃষ্টি করেছে যে, তাহলে কি দলটি আর গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। এর থেকে দলকে বের করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”

এই হতাশার পরিণতিতে কি হতে পারে? এই প্রশ্নে রিয়াজউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “এটাতো পরিস্কার যে একটা দলের মধ্যে যখন হতাশা থাকে, নেতৃত্বশূণ্য থাকে, তখন আস্তে আস্তে দলটির উপযোগীতা কমে যায়।”

“একসময়ে প্রতাপশালী বিএনপি ক্ষমতায় ছিল, বিরোধীদলেও অত্যন্ত প্রতাপের সাথে ছিল, সেই দল এখন ভাল করে একটা সভা বা মিছিল করতে পারে না। এই অবস্থার মধ্যেতো দলটি ইতিমধ্যে চলে গেছে।”

“এই নির্বাচন এই দলের জন্য একটি বড় আঘাত। নির্বাচন কিভাবে হয়েছে, প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে না কী হয়েছে, এগুলি নিয়ে অনেক বিতর্ক চলবে। এটি বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, এর তাৎক্ষণিকভাবে বিএনপির সব পর্যায়ে হতাশা তৈরি হয়েছে।

এসএইচ-০৪/০২/১৯ (কাদির কল্লোল, বিবিসি)