বাংলাদেশে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা

২০১৮ সালটিতে বাংলাদেশে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছিল যা তখন আলোচনার কেন্দ্রে ছিল। একাদশ সংসদ নির্বাচন ছাড়াও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ নানা ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী হয়েছে ২০১৮ সাল।

১. সংসদ নির্বাচন ও রাজনীতির উত্তাপ
২০১৮ সালের পুরো সময়টাতেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি আলোচনায় ছিল। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী কার্যক্রমের তৎপরতা অক্টোবরের শুরু থেকে দেখা যায়।

১৩ই অক্টোবর গণফোরাম নেতা ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি এবং কয়েকটি ছোট দল জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট নামে নতুন একটি জোট গঠনের কথা ঘোষণা করে।

জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন এবং সংসদ বাতিলসহ আরো কিছু দাবি তোলে তারা। পরে ২৪শে অক্টোবর এসব দাবি নিয়ে সিলেট শহরে প্রথম জনসভা করে তারা।

এরপর গত ২৮শে অক্টোবর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে একটি চিঠিতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই তাদের সাত-দফা দাবি নিয়ে সরকারকে আলোচনায় বসার প্রস্তাব করা হয়।

ঐ প্রস্তাবের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংলাপে বসতে রাজী হওয়ার সরকারি সিদ্ধান্তে বিরোধী দলীয় নেতারা বিস্মিত হন।

পরে অবশ্য ৭ই নভেম্বর সরকার ও ঐক্যফ্রন্ট আরো এক দফায় সংলাপে বসলে কার্যতঃ কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি। পরের দিনই মতপার্থক্য আর বিতর্কের মধ্যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছিল নির্বাচন কমিশন।

তখন ২৩শে ডিসেম্বর ভোট গ্রহণের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিল। পরে অবশ্য তা পিছিয়ে ৩০শে ডিসেম্বর নেওয়া হয়।

এর মধ্যে ১১ই নভেম্বর নির্বাচনে অংশগ্রহণের নীতিগত সিদ্ধান্ত জানায় ঐক্যফ্রন্ট। কিন্তু ড. কামাল হোসেন কোন মনোনয়নপত্র জমা দেননি। এসময় ধানের শীষ প্রতীকে জামায়াতে ইসলামের নেতাদের মনোনয়ন দেওয়ার ব্যাপারটিও আলোচনায় আসে।

এদিকে ৯ই ডিসেম্বর মহাজোট ও ঐক্যফ্রন্ট শরীকদের মধ্যে আসন ভাগাভাগি চূড়ান্ত করার পরের দিনই ১০ই ডিসেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারণা শুরু হয়।

তবে ১২ই ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া থেকে এবং বিরোধী জাতীয় ঐক্যজোট নেতা ড. কামাল হোসেন সিলেট থেকে তাদের প্রচারাভিযান শুরু করেন।

১৭ই ডিসেম্বর ঐক্যফ্রন্ট এবং ১৮ই ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে।

তবে নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রে বিরোধী কোন প্রার্থীই লেভেল-প্লেয়িং ফিল্ড পায়নি বলে নানা রকম অভিযোগ আসে। ঐক্যফ্রন্ট প্রার্থী-সমর্থকদের উপর পুলিশী হামলা ও ব্যাপক ধরপাকড়ের খবরও পাওয়া যায়।

এসব অভিযোগ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সাথে ২৫শে ডিসেম্বর বৈঠকে বসলেও এক পর্যায়ে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যজোট ওয়াকআউট করে। পরের দিন তারা প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ দাবি করেন।

তবে নির্বাচনের আগের দিন থেকে মোবাইল ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করেছিল বিটিআরসি। ভোটের পরের দিন পর্যন্ত থ্রি-জি ও ফোর-জি সেবা ব্যাহত হয়েছে বলে জানা গেছে।

এরই মধ্যে ৩০শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে একাদশ সংসদ নির্বাচন। ২৯৯ টি আসনে ভোট গ্রহণ হয়। গাইবান্ধার একটি আসনে একজন প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে সেই আসনে নির্বাচন স্থগিত করা হয়।

আওয়ামী লীগ ও মহাজোট ২৮৮টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। অপর দিকে ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপি জোট ৭টি আসন পায়। অন্যান্যরা বাকি ৩টি আসন পায়।

তবে ভোট গ্রহণের সময় বিবিসির ক্যামেরায় বেশ কিছু অনিয়ম ধরা পড়েছিল।

বিরোধী জোটে ‘কারচুপি ও অনিয়মের’ অভিযোগে নির্বাচনী ফলাফল প্রত্যাখান করে পুন:নির্বাচনের দাবি তুললেও আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশন তা নাকচ করে দিয়েছে।

২. খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড ও নির্বাচনে অযোগ্য
গত বছরের শুরু থেকে সবচেয়ে বড় আলোচিত বিষয়টি ছিল বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড।

২০০৮-এর ৩রা জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশনের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয় ঢাকার একটি বিশেষ আদালত। তখন থেকেই তিনি জেলে আছেন।

এরপর ৩০শে অক্টোবর একই মামলায় খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ১০ বছর করেছে হাইকোর্ট। অন্যদিকে আরেকটি দুর্নীতি মামলায় (জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট) আরেকটি বিশেষ আদালত তাকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়।

তবু একাদশ সংসদ নির্বাচনের অংশগ্রহণ করার জন্য বিএনপির থেকে তার পক্ষে ফেনী-১ এবং বগুড়া ৬ ও ৭ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেয়া হয়েছিল।

তবে ২রা ডিসেম্বর বাছাইয়ের সময় কারাদণ্ডের কারণ দেখিয়ে খালেদা জিয়ার প্রার্থিতা বাতিল করে দেন রিটার্নিং কর্মকর্তারা। নির্বাচন কমিশনে আপিল করা হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নেয়া সিদ্ধান্তে সেই আপিল নাকচ হয়ে যায়।

পরে ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে গিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন। ১৩ই ডিসেম্বর খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন কি-না সে নিয়ে বিভক্ত রায় দেয় হাইকোর্ট বেঞ্চ। এই রিট আবেদনের শুনানির পর সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের প্রতি অনাস্থা জানিয়েছিলেন তাঁর আইনজীবীরা। এরপর তাঁর রিট তৃতীয় আর একটি বেঞ্চে পাঠানো হলে সেটিও ১৮ই ডিসেম্বর তা খারিজ করে দেয় আদালত।

খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এই প্রথমবারের মতো তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হলেন।

৩. নেপাল বিমান দুর্ঘটনা
২০১৮ সালের একটি বড় ঘটনা ছিল নেপালের কাঠমান্ডুতে ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান দুর্ঘটনা।

১২ই মার্চ ওই বিমানটি বিধ্বস্ত হলে ৪৯ জন মানুষ নিহত হন। এর মধ্যে ২৬জন আরোহী বাংলাদেশী।

এই দুর্ঘটনার পর থেকে আকাশপথের নিরাপত্তা ইস্যুতে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হয়েছিল। পরে ১৯শে মার্চ নিহত ২৬ জনের মধ্যে ২৩ জনের লাশ ঢাকায় এনে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকিদেরটা পরে আনা হয়।

এই ঘটনার তদন্তের আগেই দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল। এমনকি দুর্ঘটনার পরপরই ককপিট এবং কন্ট্রোল রুম এটিসির মধ্যকার কথোপকথন ফাঁস হয়ে যায়।

বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিমান সংস্থা এবং নেপালের কর্মকর্তারা পাল্টাপাল্টি দোষারোপও করেছিলেন।

এ দুর্ঘটনার পর নেপাল কর্তৃপক্ষ অ্যাকসিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন কমিশন গঠন করেছিল। তাদের খসড়া রিপোর্টের কপি নেপালের কাঠমান্ডু পোস্ট পত্রিকা ও আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপির হাতে গিয়েছিল বলে তারা দাবি করে।

এ দুটি সংবাদ মাধ্যম লিখেছিল যে তদন্ত রিপোর্টে বিমান দুর্ঘটনার জন্য পাইলট আবিদ সুলতানের আচরণকে দায়ী করা হয়েছে। তবে সেটিকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে আখ্যা দিয়ে গত ২৮শে অগাস্ট তদন্ত কমিশনের সদস্য বাংলাদেশের সালাউদ্দিন এম রহমতউল্লাহ বলেছিলেন, “ইউএস বাংলা বিমান দুর্ঘটনার তদন্ত ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে।”

৪. মাদক বিরোধী অভিযান
চলতি বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে যে ইস্যুটা ব্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছিল সেটি হলো মাদকের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান।

বছরের মে মাসের ১৫ তারিখ থেকে শুরু করে অক্টোবর পর্যন্ত মাদক-বিরোধী অভিযানে চার শতাধিক লোক নিহত হয়েছে বলে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে।

মাদক বিরোধী অভিযানকে অনেকেই সাধুবাদ জানালেও কথিত বন্দুকযুদ্ধ নিয়ে মানবাধিকার কর্মীরা বরাবরই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। উদ্বেগের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে তারা বিভিন্ন ফোরামে তুলে ধরেছেন।

তবে ২৬শে মে টেকনাফে কথিত বন্দুকযুদ্ধে সেখানকার পৌর কাউন্সিলর ও স্থানীয় যুবলীগের সাবেক সভাপতি মো. একরামুল হকের নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে রেকর্ড করা অডিও প্রকাশ হওয়ার পর এই ঘটনা নিয়ে সামাজিক নেটওয়ার্কে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

এর মধ্যেই ৩০শে মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন যে মাদক বিরোধী অভিযান চলছে তাতে কাউকেই রেহাই দেয়া হবে না।

৫. নিরাপদ সড়ক আন্দোলন
সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবীতে আন্দোলন বাংলাদেশে এর আগে হলেও গত বছরের অগাস্ট মাসের মত আলোড়ন তৈরি হয়নি কখনোই।

২৯শে জুলাই ঢাকার রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাস চাপায় নিহত হওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা।

প্রথম কয়েকদিন স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও পরবর্তীতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ হয় ঢাকার বিভিন্ন স্থানে। এসময় তাদের প্ল্যাকার্ড – পোস্টারসহ নানা স্লোগানে উত্তাল হয় ঢাকার রাস্তা।

তারা রাস্তায় নেমে বিভিন্ন যানবাহনের লাইসেন্স ও কাগজপত্রও চেক করছিল।

তাদের এই আন্দোলন অল্প সময়ের মধ্যেই সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

তবে ৪ঠা অগাস্ট কিছু গুজব ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শনিবার আওয়ামী লীগ কর্মীদের সাথে সংঘর্ষে ঢাকার ধানমণ্ডির জিগাতলা এবং সায়েন্স ল্যাব মোড় অনেকটা রণক্ষেত্রে রূপ নিয়েছিল।

পরে গত ৫ই আগস্ট আলোচিত শহিদুল আলমকে পুলিশ আটক করে। তার বিরুদ্ধে ইন্টারনেটে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে ‘অসত্য এবং উস্কানিমূলক তথ্য’ ছড়ানোর অভিযোগে তথ্য-প্রযুক্তি আইনে মামলা করা হয়।

শহিদুল আলমের মুক্তি দাবি করে অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, ফটোগ্রাফার রঘু রাই, ব্রিটিশ টিভি তারকা কনি হক সহ দেশ-বিদেশের অনেক ব্যক্তি ও সংস্থার পক্ষ থেকে বিবৃতি দেয়া হয়। পরে ১০৮ দিন কারাগারে থাকার পর তিনি জামিনে বের হন।

পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত টাইম সাময়িকী ২০১৮ সালের আলোচিত চরিত্র “দ্যা গার্ডিয়ান্স এন্ড দ্য ওয়ার অন ট্রুথ” তালিকায় তিনি স্থান পান।

আন্দোলনের সময় আল জাজিরা টেলিভিশনে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সরকারের কড়া সমালোচনা করেছিলেন শহিদুল আলম। তারপরই তাকে গ্রেফতার করা হয়।

এদিকে ৭ই অগাস্ট বসুন্ধরা এবং বাড্ডা এলাকায় সংঘর্ষ ও সহিংসতার সাথে জড়িত সন্দেহে এবং পুলিশের কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগে ঢাকায় কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ জন ছাত্রকে আটক করে পুলিশ। ফলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

তবে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা আর পরিবহন খাতের উন্নয়নের জন্য শিক্ষার্থীদের নানামুখী দাবির ‘দ্রুত ও আইনানুযায়ী বাস্তবায়নের’ প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে।

এই আন্দোলনের মুখেই যেন টনক নড়ে সরকারের, নড়েচড়ে বসে যানবাহন খাতের সাথে সম্পৃক্ত চালক-মালিক, সরকারি-বেসরকারি সকল সংস্থাই।

আন্দোলনের পর ১৯শে সেপ্টেম্বর ‘বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন বিল ২০১৮’ জাতীয় সংসদে পাশ হয়।

তবে আইনের বিরোধীতা করে পরিবহন শ্রমিক ও মালিকরাও কয়েকদিন পরিবহন ধর্মঘট পালন করে।

এসএইচ-১৮/০২/১৯ (সরদার রনি, বিবিসি)