নতুন বছরে মন্ত্রী চাই

বাংলাদেশে ২০১৮ আর ২০১৯ সাল যেন একাকার হয়ে গেছে৷ বছরের একদিন বাকি থাকতে যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তারই প্রতিক্রিয়া চলছে নতুন বছরে৷ আর নতুন বছরে প্রধান দাবি হয়ে উঠেছে ‘‘আমাদের এলাকায় মন্ত্রী চাই’’৷

সাধারণ মানুষের মধ্যে একটি ধারণা হয়েছে, এলাকায় মন্ত্রী থাকলে উন্নয়ন বেশি হয়৷ এবার বিরোধী দল পেয়েছে মাত্র ৭টি আসন৷ সরকারি দল বা মহাজোটময় পুরো দেশ৷ তাই পুরো দেশ থেকেই আওয়াজ উঠেছে যার যার এলাকার সংসদ সদস্যকে যেন মন্ত্রী করা হয়৷ কিন্তু বাস্তবে তো আর তা ঘটে না৷ কারণ, যত এমপি তত মন্ত্রী নয়৷ ফলে মন্ত্রিত্ব না পাওয়ার হতাশা থাকবেই৷ আর এর সঙ্গে নতুন বছরে থাকছে দুর্বলতম বিরোধী দলের সংসদ, যা সাধারণ মানুষের জন্য কোনো সুখবর নয়৷

২০১৪ সালের জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’-এর যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি শুরু হয়েছে, তা হয়তো আরো ৫ বছর বাংলাদেশে অব্যাহত থাকবে৷ হয়তোবা ‘উপদ্রপহীন এবং শন্তিপূর্ণ’ আরো ৫টি বছর বাংলাদেশের নাগরিকদের দেখতে হবে৷ আর সত্যিকারের বিরোধী দল বিএনপি, তথা ঐক্যফ্রন্ট কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সে ব্যাপারে মন্তব্য করার সময় হয়তো এখনো আসেনি৷ তবে এখন বাংলাদেশে প্রয়োজন জনপ্রত্যাশা পূরণের মতো শক্তিশালী বিরোধী দল৷ তবে সেটা চাইলেই কি পাওয়া যায়?

২০১৮ সাল ছিল নির্বাচন আর সামাজিক আন্দোলনের বছর৷ ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি’র চেয়ারপার্সন এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দুর্নীতির মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যান৷ এরপর আরো একটি মামলায় তাঁর দণ্ড হয়৷ তিনি এখনো কারাগারে আছেন৷ এ নিয়ে বিএনপি কোনো কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলকে ব্যর্থ হয়েছে৷ তবে দু’টি সামাজিক আন্দোলন শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বেরই দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়৷ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দেলন চলে কয়েক মাস ধরে৷ তবে এই আন্দোলন তীব্র হয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে ২০১৮ সালের এপ্রিলে৷ সরকার এই আন্দোলনে জড়িতের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালিয়েছে বলে অবিযোগ রয়েছে৷ তবে শেষ পর্যন্ত অক্টোবরে সরকার সরকারি চাকরিতে সব ধরনের কোটা বাতিল করে৷

নিরাপদ সড়কের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ২০১৮ সালে উত্তাল হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ৷ ২৯ জুলাই ঢাকার রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী বাস চাপায় নিহত হওয়ার পর সাধারণ শিক্ষার্থীরা ওই আন্দোলন গড়ে তোলে৷ এই আন্দোলন নিস্ক্রিয় করতেও দমন-পীড়নের অভিযোগ ওঠে৷ আরো অনেকের সঙ্গে তখন গ্রেপ্তার হন বরেণ্য আলোচিত্রী ড. শহীদুল আলম৷

১০৮ দিন কারাগারে থাকার পর তিনি জামিনে ছাড়া পান৷ এই আন্দোলনের ফলে নতুন সড়ক পরিবহন আইন পাশ হয়৷ আর তার বিরোধিতায় সড়ক পরিবহণ শ্রমিকরা আন্দোলনের নামে সারাদেশে ২-৩দিন ব্যাপক নৈরাজ্য চালায়৷ সাধারণ যাত্রী ও চালকদের মুখে পোড়া মোবিল মেখে দিয়ে ‘মোবিল সন্ত্রাস’ প্রবর্তন করে৷ তার আগে নিরপদ সড়ক আন্দোলনের সময় পরিচিতি পায় ‘হেলমেট বাহিনী’৷ এরা সাংবাদিক ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়৷

মাদকবিরোধী অভিযানে ২০১৮ সালে ৪০০ লোক নিহত হন৷ আর বাংলাদেশে পাশ হয় বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, যাকে মুক্ত সংবাদমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতাবিরোধী বলে সমালোচনা করা হয়৷

কিন্তু এ বছরই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উঠে আসার যোগ্যতা অর্জন করে৷ সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২৪ সালে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে৷ এর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, গড় আয়ূ বৃদ্ধি এবং ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির স্বীকৃতি পায়৷ স্বীকৃতি পায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে উন্নয়নের, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে অধিক বিনিয়োগের৷ আর এই বছরেই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো, মানে স্প্যান বসানোর কাজ শুরু হয়৷ তবে বাকস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রশ্নের মুখে ছিল৷

নির্বাচনের বছর ২০১৮ সালে চমক ছিল ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট৷ ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জনের পর ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারেই বিএনপি ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নেয়৷ ফলে এবারের নির্বাচনে সব দল (৩৯টি নিবন্ধিত দল) অংশ নেয়৷ এটা বাংলাদেশে সবার অংশগ্রহনে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার আলো দেখায়৷ নির্বাচনে ইস্যু ছিল গণতন্ত্র বনাম উন্নয়ন৷বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্ট মাত্র ৭টি আসন পায়,যা অনেককেই অবাক করেছে৷

নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে তারা এরই মধ্যে নিরপেক্ষ তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন দাবি করেছে৷ তারা নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ করেছে৷ ফলে সাধারণ মানুষ তাঁদের আশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ গণতান্ত্রিক উত্তরণ দেখেনি৷ ঐক্যফ্রন্টের ৭ জন শেষ পর্যন্ত সংসদে যাবেন কিনা তা এখনো নিশ্চিত নয়৷

তবে আশার কথা, এবার ‘সত্যিকারের’ বিরোধী দল হিসেবে সংসদে বসতে যাচ্ছে জাতীয় পার্টি৷ তারা আসন পেয়েছে ২২টি৷ গত সংসদে তারা সরকারের মন্ত্রীসভায় থেকেই সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসেছিল৷

আর এই অবস্থায় সোমাবার মন্ত্রিসভা শপথ নেয়৷ বাংলাদেশে এই প্রথম দেশের প্রায় সব এলাকা থেকে মন্ত্রী করার দাবি উঠেছে৷ এনিয়ে মিছিল- মিটিং ও সড়ক অবরোধের মতো ঘটনাও ঘটেছে৷ তবে সব এলাকা থেকে মন্ত্রী করা হয়নি৷ পুরোনোদের অনেকেই বাদ পড়েছেন৷

টানা তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ৷ র্থ বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন শেখ হাসিনা৷ এটি বাংলাদেশে একটি রেকর্ড৷

নতুন বছরে নতুন সরকার নিয়ে আলোচনা আর প্রত্যাশার মাঝে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ধানের শীষে ভোট দেয়ায় এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় পুরো জাতি স্তম্ভিত হয়ে পড়ে৷ আর ফরিদপুরে নৗকায় ভোট দেয়ার অপরাধে সংখ্যালঘু হিন্দুরা নির্যাতনের শিকার হন৷ অভিযোগ, যারা নির্যাতন করেছেন তারা একজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর লোক৷ ওই স্বতন্ত্র প্রার্থী আবার আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারক পর্যায়ের এক নেতার আত্মীয়৷ খুলনা-১ আসনে ভোটের ফল ঘোষণা করতে গিয়ে হিসেবে গরমিল করেন সেখানকার জেলা প্রশাসক৷ আর তার খেসারত দিতে হয়েছে একজন সাংবাদিককে জেলে গিয়ে৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘‘উন্নয়নকে ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন গণতন্ত্র৷ আর তার জন্য প্রয়োজন সুশাসন৷ প্রয়োজন দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করা৷ এখানে উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু সুশাসন নেই৷ একই অপরাধে সরকার দলীয় লোকজন পার পেয়ে যায়৷ কিন্তু সাধারণ মানুষ বা বিরোধী লোকজনকে ছাড়া হয় না৷ আইন সবার জন্য সঠিকভাবে প্রয়োগ হয় না৷ পুলিশ প্রশাসন নগরিকবান্ধব নয়৷ এখন এগুলো আমাদের দরকার৷”

তিনি গণতন্ত্র এবং শাসনব্যবস্থার প্রশ্নে বলেন, ‘‘এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে যে, আমরা একদলীয় ব্যবস্থায় চলব, নাকি বহুদলীয় ব্যবস্থায় চলব৷ এবারের নির্বাচনের যে ফল, তাতে বিরোধী দল বলতে ওই অর্থে আর কিছু নেই৷ যদি আমাদের সিদ্ধান্ত হয় প্রায় একদলীয় মডেলে উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে অনেকটা সমাজতান্ত্রিক স্টাইলে দেশ চলবে, তাহলে তো আর সমস্যা নেই৷ কিন্তু যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চাই, তাহলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে তুলতে হবে৷ বিরোধী দল থাকতে হবে৷”

আর মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, ‘‘গতবছর যা দেখেছি, ২০১৯ সালে তা আর দেখতে চাই না৷ একটি অস্থিরতামুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ চাই৷ গণতন্ত্রের জন্য স্যাক্রিফাইস দরকার, সেটা যেন রাজনৈতিক নেতারা করেন৷ আর সমাজে ভয়ের যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তা যেন কেটে যায়৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘গণতন্ত্রের কন্ঠ চেপে ধরলে উন্নয়ন সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছায় না৷ উন্নয়ন মানুষের কাছে পৌঁছাতে হবে৷ তাহলেই প্রকৃত উন্নয়ন হবে৷”

তিনি নতুন বছরে আশার সঙ্গে আশঙ্কার কথাও বলেন৷ তিনি মনে করেন,‘‘যদি কোনো কারণে স্বৈরশাসনের কবলে দেশ পড়ে যায়, তাহলে অর্থনীতিতে ধস নামবে৷ মানুষ বিদ্রোহী হয়ে উঠবে৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমার কাছে খবর আছে অন্তত ৫০টি এলাকায় মিছিল, অবরোধ হয়েছে ওই এলাকার নির্বাচিত এমপিকে মন্ত্রী করার দাবিতে৷ সারাদেশেই এই দাবি এখন৷ এটা সাধারণ মানুষের দাবি নয়৷ দলীয় নেতা-কর্মীরা এই দাবি তুলছে৷ এর মানে হলো তারা আরো ক্ষমতা চায়৷ তারা আরো নিরঙ্কুশ আধিপত্য চায়৷ এটা ভালো লক্ষণ নয়৷”

এসএইচ-০৬/০৯/১৯ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)