বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ক ছিন্ন না হলেও অবনতি হয়েছে

সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াত-বিএনপির সম্পর্কের কিছুটা অবনতি ঘটলেও তা সম্পূর্ণ ছিন্ন হচ্ছে না এখনই। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত এবং তাদের রাজনৈতিক মিত্র বিএনপির ‘বন্ধন‘ আপাতত অটুট-ই থাকছে।

সম্প্রতি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে গুঞ্জন ওঠে, নানা দিক হিসাব-নিকাশ করে বিএনপির সঙ্গ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জামায়াত। দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছে— এমনটিই শোনা যাচ্ছিল।

কিন্তু জামায়াতের দায়িত্বশীল কয়েকজন নেতা, বিএনপির কয়েকজন নীতিনির্ধারক এবং জামায়াত-বিএনপির রাজনীতি নিয়ে কাজ করেন— এমন কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াত-বিএনপির সম্পর্কের খানিকটা অবনতি ঘটেছে, তবে সেটা ছাড়াছাড়ির পর্যায়ে যায়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ২০১০ সালে ২৯ জুন জামায়াতের তৎকালীন আমীর মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, সেক্রেটারি জেনারেল আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদী এবং ১৩ জুলাই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মো. কামারুজ্জামান ও কাদের মোল্লা গ্রেফতার হলে জোট শরিক বিএনপিকে অবলম্বন করে রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার চেষ্টা করে জামায়াত। বিভিন্ন সভা-সমাবেশে জামায়াত নেতাদেরকে ‘রাজবন্দি’ আখ্যা দিয়ে তাদের মুক্তি দাবি করায় জামায়াত-বিএনপির সম্পর্ক আরও মজবুত হয়। বিএনপির ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের আন্দোলন’ মোড় নেয় জামায়াত নেতাদের মুক্তির আন্দোলনে।

কিন্তু ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর থেকে জামায়াত-বিএনপির সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। কারণ, একের পর এক জামায়াত নেতাদের ফাঁসির রায় কার্যকর হলেও বিএনপির পক্ষ থেকে কোনো কর্মসূচি ঘোষণা বা আনুষ্ঠানিক বিবৃতি আসেনি। বিশেষ করে জামায়াতের সাবেক আমীর গোলাম আযমের মৃত্যুতেও বিএনপি কোনো বিবৃতি না দেওয়ায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ ও হতাশ হন জামায়াত নেতারা।

গোলাম আযমের মৃত্যুর পর ২০১৪ সালের ৩০ অক্টোবর তার ছোট ছেলে আব্দুল্লাহিল আমান আযমী ফেসবুকে লেখেন, “জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা আমির এবং আধ্যাত্মিক গুরুর মৃত্যুতে বিএনপির নীরবতা অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত এবং অগ্রহণযোগ্য! জামায়াতের সমর্থন ছাড়া তারা কখনোই ক্ষমতায় যেতে পারবে না— এ কথাটা যদি বিএনপি স্মরণে রাখে, তাহলে সেটা তাদের জন্য ভালো হবে। এটা আমার ‘প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ।’ এরা কত অকৃতজ্ঞ হতে পারে!”

সর্বোপরি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জামায়াতকে পাশ কাটিয়ে ড. কামাল হোসেন, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম, আ স ম আবদুর রবদের নিয়ে নির্বাচনি জোট ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন করায় বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কে আরেক দফা অবনতি ঘটে। আসন ভাগাভাগির সময় সেটা প্রকাশ্য রূপ নেয়।

বিএনপি নেতারাও জামায়াতের কিছু কর্মকাণ্ড এবং ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ আচরণে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হন। তারা বলার চেষ্টা করেন, তীব্র সমালোচনার মুখে খালেদা জিয়া জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবে আশ্রয় এবং সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে এসেছেন। অথচ খালেদা জিয়া কারাবন্দি হওয়ার পর জামায়াতের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান কোনো কর্মসূচি আসেনি। বিএনপি ঘোষিত কর্মসূচিতেও অংশ নেয়নি জামায়াত।

খালেদা জিয়া কারাবন্দি থাকা অবস্থায় গত বছর আগস্টে অনুষ্ঠিত সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জোটের সিদ্ধান্ত অমান্য করে মেয়র পদে একক প্রার্থী দেয় জামায়াত। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতের বিরুদ্ধেও লড়তে হয় বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের মেয়র প্রার্থীকে। ওই নির্বাচনে জয় পায় বিএনপি।

সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২২টি আসনে জামায়াতকে ধানের শীষ প্রতীক দেয় বিএনপি। কিন্তু নির্বাচনের দিন বিএনপির সঙ্গে কোনো প্রকার আলাপ-আলোচনা ছাড়াই ২২টি আসনে একযোগে ভোট বর্জন করে জামায়াত। এতে ক্ষুব্ধ হন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। নির্বাচনের পর জামায়াতের মজলিসের শুরার বৈঠকে প্রস্তাব পাস হয়, বিএনপির পরাজয়ের দায় নেবে না তারা।

এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে সম্প্রতি গুঞ্জন ওঠে, জানুয়ারির মাঝামাঝি অনুষ্ঠিত মজলিসে শুরার বৈঠকে জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বিএনপির সঙ্গে আর থাকবে না তারা। ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখবে না স্বাধীনতাবিরোধী এই রাজনৈতিক দলটি।

কিন্তু বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করে বৃহস্পতিবার জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ ও মজলিসে শুরার সদস্য এহসানুল মাহবুব জুবায়ের সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিএনপি বা ২০ দল ছাড়ার কোনো সিদ্ধান্ত জামায়াত নেয়নি। এ ব্যাপারে কোনো বার্তাও মিডিয়াতে পাঠাইনি আমরা। যেটা সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেটা হলো উপজেলা নির্বাচনে আমরা যাচ্ছি না। আমাদের এই সিদ্ধান্তের বিষয়টি মেইল বার্তায় গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘জামায়াত এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না, আমরা জানি না। তাদের পক্ষ থেকে আমাদের কিছু জানানো হয়নি।’

এদিকে, নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একজন শীর্ষ পর্যায়ের নেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজনীতির মাঠে টিকে থাকার প্রয়োজনেই জামায়াত-বিএনপি কেউ কাউকে ছেড়ে যাবে না। তবে দুই দলের প্রধান ব্যক্তিদের সাজা, নির্বাচনে মহাবিপর্যয়, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারাসহ নানা কারণে জামায়াত-বিএনপির সম্পর্ক’র কিছুটা অবনতি ঘটেছে।’

এসএইচ-০৬/১৫/১৯ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্য সূত্র : সারাবাংলা)