শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা, ছাঁটাইয়ের ঘটনায় উদ্বেগ

মজুরি নিয়ে আন্দোলনের জেরে প্রায় ছয় হাজার পোশাক শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে৷ চাকরি হারিয়েছেন কয়েক হাজার শ্রমিক৷ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে প্রচারণা শুরু করেছে শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংগঠন৷

শ্রমিক সংগঠনের আন্তর্জাতিক জোট ‘ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইন’ গত ২৮ জানুয়ারি থেকে ৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লন্ডন, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, জেনেভা, বার্লিন, ব্রাসেলস, মাদ্রিদ ও দ্য হেগে অবস্থিত বাংলাদেশের হাইকমিশনের সামনে কর্মসূচি পালন করে৷ সেখানে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা ও ছাঁটাইয়ের ঘটনায় উদ্বেগ জানায় সংগঠনটি৷ এছাড়া অনলাইনে ‘উইস্ট্যান্ডউইথগার্মেন্টওয়ার্কার্স’ হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করেও প্রচারণা হয়েছে৷

এদিকে, শ্রমিকদের আরেক আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘ইন্ডাষ্ট্রিঅল গোবাল ইউনিয়ন’ এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘‘শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, গ্রেপ্তার ও ছাঁটাইয়ের ঘটনায় আমরা মর্মাহত৷ শ্রমিকদের মধ্যে যে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটি বন্ধ করা উচিত৷”

‘ইন্ডাস্ট্রিঅল’-এর বাংলাদেশ শাখা ‘ইন্ডাস্ট্রিঅল বাংলাদেশ কাউন্সিল’ আইবিসি সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, ৯৯টি কারখানার ১১ হাজারের বেশি শ্রমিক ছাঁটাই ও বরখাস্ত হয়েছেন৷ অনেক নিরীহ শ্রমিকের পাশাপাশি ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকেরাও হয়রানির শিকার হচ্ছেন৷

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আন্দোলনের জেরে ৫ হাজার ৮৪৫ পোশাক শ্রমিককে আসামি করে ২৮টি মামলা হয়েছে৷ এর মধ্যে গাজীপুরের কোনাবাড়ী ও গাছা, সাভার, আশুলিয়া ও টঙ্গী পূর্ব থানায় ২৭টি কারখানার করা মামলায় ৪ হাজার ৩৪৫ শ্রমিককে আসামি করা হয়েছে৷ তাঁদের মধ্যে ৫১৫ শ্রমিকের নাম উলেখ আছে, বাকিরা অজ্ঞাতনামা৷ সাভার থানায় শিল্প পুলিশের করা এক মামলায় আসামি ১ হাজার ৫০০ অজ্ঞাত শ্রমিক৷

পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘‘বাংলাদেশের পোশাক খাতনিয়ে ষড়যন্ত্র আগাগোড়াই চলছে৷ তার মধ্য দিয়ে আমরা সামনে এগুনোর চেষ্টা করছি৷ এখন কারখানায় ভাঙচুর হয়েছে৷ এই ভাঙচুরে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থাতো নেবেই৷ আর চাকরি যাওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, আমরা আইন মেনে যদি কাউকে চাকরিচ্যুত করি তাহলে তো আপনি কিছু বলতে পারবেন না৷ আর আমি কারখানা চালাতে গেলে কাউকে বাদ দিলে কিন্তু পরেরদিনই অন্য কাউকে নিতে হবে৷ ফলে শ্রমিকদের বাদ দিয়ে মালিকদের কোনো লাভ নেই৷ দেখেন, ভাঙচুরের মামলায় যারা জেলে গিয়েছিল তাদের সবাই এখন জামিনে মুক্ত৷ তারপরও তাদের এই ক্যাম্পেইন অযৌক্তিক৷”

এই ধরনের প্রচারণা অব্যাহত থাকলে দেশের পোশাক খাতের ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে বলে স্বীকার করেন বিজিএমইএর সভাপতি৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রকৃত ঘটনা না জেনেই আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনগুলো আন্দোলন করছে৷ আমরা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাকে (আইএলও) বিস্তারিতভাবে পুরো ঘটনা জানিয়েছি৷”

‘বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটি’র নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বলেন, ‘‘যারা ক্লিন ক্লথ ক্যাম্পেইনকে ষড়যন্ত্র মনে করে তাদের বিষয়ে কিছুই বলার নেই৷ এই সংগঠন সারা বিশ্বে শ্রমিকদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করে৷ আমাদের দেশে তো ইচ্ছে করলেই আমরা সব কথা বলতে পারি না৷ ফলে তাদের সহযোগিতা আমাদের নিতে হয়৷ তবে একটা বিষয় আমরা পরিষ্কার করে বলতে পারি, মালিকেরা সুপরিকল্পিতভাবে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা ওছাঁটাই শুরু করেছেন৷ মালিকেরা নিজেদের পেশিশক্তি দেখানো এবং তাঁরা যে সরকারের মধ্যে আছেন, সেটি দেখানোর জন্যই এমনটি করছেন৷ তবে এসব কাজ নেতিবাচক হয়েই শিল্পে ফিরে আসে৷”

গার্মেন্টস সেক্টর নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম৷ তিনি বলেন, ‘‘শ্রমিকদের আন্দোলন যে যৌক্তিক ছিল সেটা তো পরে প্রমাণিত হয়েছে৷ সরকার মজুরি কাঠামো সংস্কার করেছে৷ ফলে শ্রমিকরা অন্যায় দাবি নিয়ে আন্দোলন করেনি৷ তাহলে প্রশ্ন হলো তাদের কেন রাস্তায় নামতে হবে৷ এখন এই ধরনের মামলা-গ্রেফতার বাদ দিয়ে সরকারের উচিত হবে মামলাগুলো নিশর্তভাবে প্রত্যাহার করে নেয়া৷ এসব মামলায় গ্রেফতার করে শ্রমিকদের জেলে পাঠিয়ে ভালো ফল আসবে না৷ মামলা ও ছাঁটাইয়ের শিকার হওয়ায় শ্রমিকেরা আতঙ্কে আছেন৷ তাদের মধ্যে থেকে এই আতঙ্ক দূর করতে হবে, যাতে কাজের পরিবেশ ফিরে আসে৷”

এসএইচ-০৮/০১/১৯ (সমীর কুমার দে, ডয়চে ভেলে)