একতরফা নির্বাচনেও ব্যালট বাক্স ছিনতাই, হামলা

দেশে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে ৭৮টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে৷ বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করলেও নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই, পুলিশের ওপর হামলা ও ভোট কেন্দ্র দখলের ঘটনা ঘটেছে৷ অনিয়মের অভিযোগে ২৮টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে।

ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের অভিযোগে কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার হোকোডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মদিনাতুল উলুম সিনিয়র মাদ্রাসা, নাগেশ্বরী উপজেলার কুটি নাওডাঙ্গা ফোরকানিয়া ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, সদর উপজেলার শিবরাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রৌমারী উপজেলার ধনারচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং চিলমারী উপজেলার খালেদা শওকত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়- এই ৬টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত হয়েছে৷

প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতি, ধাক্কাধাক্কি ও ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের অভিযোগে সুনামগঞ্জের শাল্লা ও ধরমপাশা উপজেলার তিনটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ সাময়িকভাবে স্থগিত রয়েছে৷ আর ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের অভিযোগে কুড়িগ্রামের সদর, উলিপুর, রৌমারী, চিলমারী ও নাগেশ্বরী উপজেলার ছয়টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়৷

সিরাজগঞ্জ পৌরসভার মাহমুদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডং অফিসার ও দুই সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারকে আটক করা হয় ভোট গ্রহণের আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মারার অভিযোগে৷ ঐ কেন্দ্রটির ভোট গ্রহণও স্থগিত করা হয়৷

নাটোরে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনায় দু’জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে৷

হবিগঞ্জের বানিয়াচং শাহপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে সংঘর্ষে পুলিশ ও আনসারসহ সাতজন আহত হয়েছেন৷ এদের মধ্যে গুরুতর আহত পুলিশ কনস্টেবল জামাল উদ্দিনকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় আনা হয়েছে৷ অন্যদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে৷

হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার তিনটি কেন্দ্রে ব্যালট ছিনতাই ও জাল ভোট দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে৷ এর মধ্যে একটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত করে দেওয়া হয়েছে। আর দুটি কেন্দ্রে সাময়িকভাবে ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকলেও পরে চালু হয়৷

এদিকে ভোট কেন্দ্রগুলোতে ভোটারের উপস্থিতি ছিল অনেক কম৷ জয়পুরহাট সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ভোটকেন্ত্রে প্রথম দুই ঘন্টায় ৪টি ভোট পড়ার খবর পাওয়া গেছে৷ অধিকাংশ এলাকাতেই সকালে ভোটারের উপস্থিতি ছিল তেমন ছিল না৷ দুপুরে কিছু ভোটার দেখা গেলেও বিকেলে আবার ভোটর শূন্য হয়ে যায়৷

বিএনপি ও বামজোটের বর্জনের মধ্য দিয়ে উপজেলা পরিষদের ৭৮টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে ১৫ জন আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন৷ আর ভাইস চেয়ারম্যান ছয়জন ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে সাতজন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন৷ এরা সবাই আওয়ামী লীগের৷ চেয়ারম্যান পদে ২০৭ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৩৮৬ জন এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২৪৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন৷

উপজেলা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপে ভোট হবে ১৮ মার্চ, তৃতীয় ধাপে ২৪ মার্চ ও চতুর্থ ধাপে ৩১ মার্চ৷ ঈদের পর জুনে পঞ্চম ধাপের ভোট হওয়ার কথা রয়েছে৷ এই নির্বাচন হচ্ছে দলীয় প্রতীকে৷

প্রথম ধাপে যে ৭৮ উপজেলায় ভোট গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলো হল- রংপুর বিভাগের পঞ্চগড় সদর উপজেলা, আটোয়ারী, বোদা, দেবীগঞ্জ ও তেঁতুলিয়া; কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী, ফুলবাড়ী, উলিপুর, নাগেশ্বরী, রাজারহাট, রাজিবপুর, কুড়িগ্রাম সদর, চিলমারী ও রৌমারী উপজেলা; নীলফামারী সদর, ডোমার, ডিমলা, জলঢাকা, সৈয়দপুর ও কিশোরগঞ্জ উপজেলা এবং লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা ও কালীগঞ্জ উপজেলা৷

ময়মনসিংহ বিভাগের জামালপুর সদর, সরিষাবাড়ী, ইসলামপুর, বকশীগঞ্জ ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা এবং নেত্রকোণা সদর, বারহাট্টা, দুর্গাপুর, খালিয়াজুরী, মোহনগঞ্জ, কেন্দুয়া, কলমাকান্দা ও মদন উপজেলা৷

সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দিরাই, শাল্লা, ধর্মপাশা, বিশ্বম্ভরপুর ও তাহিরপুর উপজেলা এবং হবিগঞ্জ সদর, বাহুবল, মাধবপুর, চুনারুঘাট, লাখাই, নবীগঞ্জ, আজমিরীগঞ্জ ও বানিয়াচং উপজেলা৷

রাজশাহী বিভাগের সিরাজগঞ্জ সদর, বেলকুচি, চৌহালী, কাজীপুর, রায়গঞ্জ, শাহজাদপুর, তাড়াশ ও উল্লাপাড়া উপজেলা; জয়পুরহাট সদর, পাঁচবিবি, আক্কেলপুর, কালাই ও ক্ষেতলাল উপজেলা; নাটোরের বাগাতিপাড়া, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, লালপুর ও সিংড়া; রাজশাহী জেলার তানোর, গোদাগাড়ী, মোহনপুর, বাগমারা, পুঠিয়া, দুর্গাপুর, চারঘাট ও বাঘা উপজেলা৷

উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপ শেষ হওয়ার পর সুশানের জন্য নাগরিক সুজন-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার  বলেন, ‘‘পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে মানুষ নির্বাচনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে৷ ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে৷ ফলে ঢাকা উত্তর সিটি নির্বাচনে মানুষ ভোট দেয়নি বললেই চলে৷ আর উপজেলা নির্বাচনের প্রথম ধাপে তা আবারো প্রমাণিত হল৷ ভোটার তেমন ভোট কেন্দ্রে যায়নি৷ অথচ স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ থাকে সবচেয়ে বেশি৷”

তিনি বলেন, ‘‘আবার এই ভোটারবিহীন নির্বাচনেও ভোটকেন্দ্র দখল হয়৷ তাই বোঝাই যায় যে নির্বাচনী ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে৷ প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের আস্থা হারিয়েছে৷ তাই এখন প্রয়োজন নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করা৷ এটা নির্বাচন কমিশন, সরকার, রাজনৈতিক দল সবার দায়িত্ব৷ নির্বাচনী ব্যবস্থা এভাবে ভেঙে পড়লে জাতি গভীর সংকটে পড়বে৷”

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘সিইসি এভিএম থাকলে আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরতো না বলে প্রকারান্তরে ও কৌশলে ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনিয়মের কথাই তুলে ধরেছেন৷”

আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনূ মজুমদার বলেন, ‘‘বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ার কারণে ভোটার উপস্থিতি কম হয়েছে৷ তবে শুধু সেটাই কারণ নয়৷ ভোটের প্রতি মানুষের আগ্রহও কমে গেছে৷ তারা হয়তো মনে করেন ভোটে তাদের মতামতের প্রতিফলন হবে না৷ ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে যে কথা হচ্ছে যে সমালোচনা হচ্ছে এটা তারই প্রভাব৷”

তিনি বলেন, ‘‘আমাদের এখানে নির্বাচনী ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠার কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে৷ আমরা কেয়ার টেকার ব্যবস্থা নিয়ে দৌঁড়ঝাপ করেছি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করিনি৷ আমি মনে করি, এখন আমাদের পরীক্ষার কাল চলছে৷ আমাদের এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে অনেক সময় লাগবে৷”

এসএইচ-১০/১১/১৯ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)