ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি সংকটে!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব পড়েছে বলে মন্তব্য ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্নার৷ সাবেক জিএস ডা. মুশতাক বলছেন, নির্বাচনের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাবমূর্তির সংকটে ফেলবে৷

২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচনে উৎসাহ উদ্দীপনা কোনো অংশেই কম ছিলনা৷ তাই সোমবার সকাল ৮টায় ভোট শুরুর আগেই বিভিন্ন হলে ভোটার শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ লাইন দেখা দেয়৷ তবে ভোট শুরুর পরই পরিস্থিতি পালটে যেতে থাকে৷ কুয়েত-মৈত্রী ছাত্রী হলে বস্তা বর্তি সিল (ক্রস) দেয়া ভোট পাওয়ার পর উত্তেজনা দেখা দেয়৷ ওই হলের প্রাধ্যক্ষকে সরিয়ে দিয়ে তিন ঘণ্টা পর ভোটগ্রহণ শুরু হয়৷ এদিকে, দুপুরের দিকে রোকেয়া হলেও এক ঘণ্টার জন্য ভোট গ্রহণ স্থগিত থাকে৷ সেখানে নিয়মের বাইরে ভিন্ন জায়গায় সাদা ব্যালট পেপার নিয়ে উত্তেজনা হয়৷ অভিযোগ, ওই হলে হামলার শিকার হন কোটা সংস্কার আন্দোলনের ভিপি প্রার্থী নুরুল হক নূরু৷ বাম জোটের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দীও হামলার শিকার হন বলে অভিযোগ করা হয়৷

নির্বাচনে শাসক দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের প্রভাব ছিল স্পষ্ট৷

ভোট দিতে ২২ মিনিট!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে স্বাধীনভাবে এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন৷ তাঁদের একজন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. ফাহমিদুল হক বলেন, ‘‘কুয়েত মৈত্রী হলে সিল দেয়া ব্যালট পেপার উদ্ধারের ঘটনাতো সবাই জানেন৷ এর বাইরে আরো কিছু ঘটনা আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি৷ তারমধ্যে আমরা নিজেরাই দেখেছি, অনাবাসিক অনেক ভোটারকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ আমাদের সামনেই ঘটেছে৷ ভেতরে জটলা করে ভোটারদের বিরুদ্ধে একধরণের ব্যারিয়ার সৃষ্টি করা করা হয়েছে৷ কিছু ভোটার বুথে ঢুকে দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ করেছে৷ আমরা দেখেছি কেউ কেউ ২২ মিনিট পর্যন্ত সময় নিয়েছে৷ আস্থাহীনতার কারণে রোকেয়া হলে সাদা ব্যালট পেপার নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়৷’’

নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘‘তাঁরা যে দায়িত্ব পালন করেননি, তা আমি বলবনা৷ তাঁরা তাঁদের মতো দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছেন৷ তারপরও এই সব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷’’

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কোথায় যাবে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি হেসে বলেন, ‘‘এই প্রশ্নতো আমারও৷ সবমিলিয়ে আমরা যা দেখলাম আজকে, আমরা খুবই মর্মাহত৷ বিশেষ করে কুয়েত মৈত্রী হলের ঘটনাতো লজ্জাকর৷’’

এবার ডাকসু নির্বাচনে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, তা অতীতে কখনো হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট অনেকেই মন্তব্য করেছেন৷ এমনকি ১৯৮৯ এবং ১৯৯০ সালে নির্বাচন হয়েছিল সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের সময়৷ তখনও ডাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে ভোট দিয়েছেন, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি৷

‘শাসক দলের সাজানো ছকে নির্বাচন’

ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না (১৯৮০) অবশ্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এর আগে ১৯৭৩ সালে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছিল, তা করেছিল ছাত্রলীগ৷ তবে তারা সেটা করেও জিততে পারেনি৷ এবার আবার ঘটলো আগেই ব্যালট পেপারে সিল দেয়ার ঘটনা৷ আর এটাও করল ছাত্রলীগ৷ ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের দির আগের রাতে যেমন ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়েছিল, সেরকমই এবার ডাকসু নির্বাচনে আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল দিয়ে রাখা হয়েছে৷ জাতীয় নির্বাচনে অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে ভোট ডাকাতি করেছে৷ এবার ডাকসু নির্বাচনে চুরি করেছে৷ কিন্তু দক্ষতার সঙ্গে না করতে পারায় তারা ধরা পড়েছে৷ একটা ধরা পড়েছে, আরো হয়েছে কিনা আমরা তাতো জানিনা৷’’

তাঁর মতে, ‘‘এটা শাসক দলের সাজানো ছকে নির্বাচন৷ তারা কোনোভাবে ডাকসু হাতছাড়া করতে চায়নি৷’’

ডাকসুর সাবেক ভিপি মান্না বলেন, ‘‘গত ১০-১২ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই আদর্শের জায়গা নষ্ট হয়ে গেছে৷ ফার্স্ট ইয়ারের ছেলেরা হল পাহারা দিচ্ছে৷ তাদের কথামত ভোট দিতে বাধ্য করেছে৷ তারপরও ইতিবাচক দিক হলো এত কিছুর পরও এটা সাধারণ শিক্ষার্থীরা ধরেছেন, তাঁরা প্রতিবাদ করেছেন৷’’

তিনি বলেন, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সেই নৈতিকতা নেই৷ থাকলে যাঁরা নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত তাঁরা এটা কীভাবে হতে দিলেন! তাঁরা কিছু কারেকশনের নামে এই নির্বাচনকে বৈধতা দিলেন৷’’

‘হতাশ হয়েছি’

ডাকসুর সাবেক জিএস ডা. মুশতাক হোসেন (১৯৮৯) বলেন, ‘‘সকাল বেলা কুয়েত মৈত্রী হলের ঘটনা দেখেতো হতাশ হয়েছি৷ পরে আরো জানলাম অনাবাসিক ছাত্রদের ভোট দিতে দেয়নি ছাত্রলীগ৷ ভোটের লাইন তাঁরা নানা কৌশলে দখলে রেখেছে৷ ভয়ভীতি দেখিয়েছে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘অতীতে এমন ঘটনা ঘটেনি৷ এবারের ঘটনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাবমূর্তির সংকটে ফেলে দেবে৷ শিক্ষকরা তাঁদের নৈতিকতা দিয়ে এই পরিস্থিতি এড়াতে পারতেন৷ তাঁরা তা পারলেন না৷ তারপরও নির্বাচনের মাধ্যমে ২৮ বছরে অচলায়তন ভেঙেছে এটা ভালো দিক৷’’

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘‘দুই-একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া খুবই উৎসবমুখর পরিবেশে এবং গণতন্ত্রের মূল্যবোধের বিশ্বাসে ভোট হয়েছে৷’’ সিল দেয়া ব্যালট পেপারের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি জরুরি মিটিং-এ আছেন বলে ফোনের লাইন কেটে দেন৷

এদিকে, ভোটগ্রহণ শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘আমি শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ জানাই৷ তারা সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে৷ তারা গণতন্ত্রের রীতিনীতি অনুসরণ করেই ভোট দিয়েছে৷ আমি অনেক কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি৷ সেখানে দেখেছি শিক্ষার্থীরা লাইন দিয়ে ভোট দিয়েছে৷’’

প্রসঙ্গত, এবারের এবারের ডাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪২ হাজার ৯২৩ জন৷ ডাকসুর ২৫টি পদের বিপরীতে লড়েছেন ২২৯ জন প্রার্থী৷ এর মধ্যে সহসভাপতি (ভিপি) পদে ২১ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ১৪ এবং সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন ১৩ জন প্রার্থী৷ এছাড়া ১৮টি হলের ছাত্র সংসদগুলোতে ১৩টি পদে নির্বাচন হয়েছে৷ তবে ছাত্রলীগ ছাড়া আর সবাই এই নির্বাচন অনিয়মের অভিযোগে শেষ পর্যন্ত বর্জন এবং প্রত্যাখ্যান করেছে৷ তারা নতুন নির্বাচনের দাবিতে মঙ্গলবার থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে৷

এসএইচ-৩০/১১/১৯ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)