ডাকসু নির্বাচনের চুলচেরা বিশ্লেষন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি ) পদে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছেন কোটা আন্দোলনের নেতা হিসেবে পরিচিত সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের প্রার্থী নুরুল হক নুর।

ডাকসুর বাকি পদগুলো ছাত্রলীগের নেতারা বিজয়ী হলেও, হল নির্বাচনে অনেক হলে বিজয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। এমনকি মেয়েদের একটি হলের সবগুলো পদেই বিজয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।

নুরুল হক নূর বলেন, “যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হতো, প্রত্যেকটা হলে ক্ষমতাসীন দলের বাইরে যারা রয়েছে, তারাই নির্বাচিত হতো।”

“আমাদের ভিসি স্যার যদি সুষ্ঠু নির্বাচন দেন, তাহলে ছাত্রলীগ একটি সদস্য পদও পাবে না,” তিনি দাবি করেছেন।

দীর্ঘ ২৮ বছর পর ডাকসুর এই নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হলো।

১৯৭৯-৮০ মেয়াদে দুই মেয়াদে ডাকসুর ভিপি হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন মাহমুদুর রহমান মান্না।

তিনি বলছেন, ” এবারের মতো ঘটনা ঘটেছিল ১৯৭৩ সালে। তখন ডাকসু নির্বাচন হওয়ার পরেও ব্যালট বাক্স ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল। পরে আর ভোট গণনাই হয়নি।”

“সেই নির্বাচনের কোন ফলাফলও হয়নি। এরপরে আর ডাকসু নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি। এতবছর পরে ডাকসু নির্বাচন ঘিরে এতো অনিয়মের ঘটনা ঘটলো।”

এবারের ডাকসু নির্বাচনকে তিনি ভোটের ফলাফল বলে মনে করছেন না। কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, “আগের রাতেই ব্যালট বক্স নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে কি হয়েছে, কেউ জানে না।”

তিনি বলছেন, ”আন্দোলন-কর্মসূচীর ঘোষণা না দেয়া হলে ভিপি হিসাবে নুরুল হকের পদটিও দেয়া হতো না। শুধুমাত্র আন্দোলনের মুখে হয়তো নুরুল হকের পদটি তারা নিতে পারেনি।”

তিনি বলছেন, মেয়েদের হলে যেহেতু পেশিশক্তি কম দেখানো যায়, তাই সেখানে খানিকটা নিরপেক্ষ ভোট হয়েছে। তাই অনেকে নিরপেক্ষভাবে সেখানে জয় পেয়েছে।

মাহমুদুর রহমান বলছেন, “আমি এটাকে নির্বাচন বলবো না, এটা হচ্ছে কারো কারো ইচ্ছাপূরণের ব্যাপার।”

তবে ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচনের সঙ্গে এর পার্থক্য হলো, সেখানে কোন প্রতিবাদ হয়নি, এখানে প্রতিবাদ হচ্ছে।

১৯৮৯-৯০ মেয়াদে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন মোস্তাক আহমেদ।

তিনি বলছিলেন, সরকার সমর্থক ছাত্র গোষ্ঠীর গত ১০বছর ধরে যে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল, সেটার বিরুদ্ধেই সাধারণ ছাত্রদের মনোভাব এই ভোটের মাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে।

”যেসব হলে দখলদারিত্ব ধরে রাখতে পেরেছে ছাত্রলীগ, সেখানে তারা জয় পেয়েছে। কিন্তু যেখানে তাদের নিয়ন্ত্রণ কম ছিল, যেমন মেয়েদের অনেক হলে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বিজয়ী হয়েছে।”

“এর মাধ্যমে আসলে বোঝা যায়, সাধারণ ছাত্ররা বিকল্প কোন ক্ষমতাকে বেছে নিতে চেয়েছিল। হয়তো ভয়ভীতির কারণে ছেলেদের হলে সেটা পুরোপুরি দেখা যায়নি।”

তিনি বলেন, “কিন্তু আমার ধারণা, অনিয়ম না হলে বা ভোট সুষ্ঠু হলে আরো অনেক পদে স্বতন্ত্র বা ছাত্রলীগের প্রার্থীরা বিজয়ী হতো।”

ছাত্রলীগ যেভাবে ভাবছে, সেভাবে সাধারণ ছাত্রদের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা যে নেই, সেটাই পরিষ্কার হয়েছে বলে তিনি মনে করছেন।

মোস্তাক আহমেদ যখন নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখনো রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল সাবেক সামরিক শাসক এরশাদ এবং তার দল জাতীয় পার্টি।

সেই সময় ডাকসু নির্বাচনে দলীয় প্রভাবের বিষয়টি কতটা ছিল?

আহমেদ বলছেন, ”নির্বাচনের পরে ছোটখাটো অভিযোগ শোনা গেলেও, ছাত্রদের আস্থা ছিল। কিন্তু এবার যেমন অনিয়ম, ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠছে, এরকম কোন অভিযোগ কখনো আসেনি।”

“তখনো নানা দল থাকলেও, ছাত্রদের মধ্যে যেমন ভারসাম্য ছিল, শিক্ষকরাও সবাই একদলীয় হয়ে ওঠেননি।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ছাত্র সংসদের ইতিহাসে দেখা গেছে, বরাবরই সংগঠনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ছাত্ররা হেরেছে।

স্বাধীনতার পর প্রথম ডাকসু নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালে। সেই নির্বাচনে ছাত্রলীগ একটি পদও পায়নি। তবে ভোট গণনার ফলাফল ঘোষণা না হওয়ায় পরবর্তী ছয় বছরে আর নির্বাচন হয়নি।

পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে ৭৯, ৮০ ও ৮২ সালে তিনটি নির্বাচন হয়। ৮০ ও ৮২ সালের নির্বাচনে ছাত্রদল বেশ কয়েকটি হলের ভিপি ও জিএস পদে জয় পায়।

৭৯ ও ৮০ সালের নির্বাচনে পরপর দুইবার ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হন জাসদ ছাত্রলীগের মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারুজ্জামান পরিষদ

৮২ সালের নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হন আখতারুজ্জামান ও জিএস নির্বাচিত হন জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু।।

এরপর প্রায় টানা সাতবছর বন্ধ থাকার পর ডাকসু নির্বাচন হয় ৮৯ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি। সেই নির্বাচনে ভিপি হয়েছিলেন ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের জোটের প্রার্থী সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ।

এরপরের পরের বছরের নির্বাচনে ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হন ছাত্রদল থেকে, আমানউল্লাহ আমান ও খায়রুখ কবির খোকন।

এসএইচ-২৯/১২/১৯ (সায়েদুল ইসলাম, বিবিসি)