গ্যাসের দাম বাড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ মানুষ

আবারো গ্যাসের দাম বাড়বে বাংলাদেশে৷ তিন দিন ধরে চলা গণশুনানি শেষ হয়েছে৷ কম-বেশি যাই বাড়ুক, এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন সাধারণ মানুষ৷ জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে, ক্ষতি হবে ব্যবসায়ীদেরও৷ বিদেশে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে আরো বেশি লড়তে হবে৷

এবার গ্যাসের দাম বৃদ্ধির শুরুতেই বিরোধীতা করেছে ‘কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ’ বা ক্যাব৷ বিইআরসি গত অক্টোবরে গ্যাসের দাম বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা চ্যালেঞ্জ করে ক্যাব-এর আহ্বায়ক ও স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন চলতি বছরের জানুয়ারিতে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদনটি করেন৷

নতুন করে দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরুর পর তিনি হাইকোর্টে একটি সম্পূরক আবেদন করেন, যার ওপর বুধবার শুনানি হয়৷ বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আগামী ৩১ মার্চ আদেশের জন্য দিন রেখেছেন৷ ওই দিন এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানা যাবে৷

আদালতে আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া৷ তিনি বলেন, ‘‘গণশুনানির কার্যক্রম আমরা স্থগিত করতে চেয়েছিলাম৷ কিন্তু আদালত বলেছে, গণশুনানিতে তো আর দাম বাড়ানো হচ্ছে না, ফলে শুনানি চলতে পারে৷ তবে ৩১শে মার্চ সিদ্ধান্ত পাওয়া যাবে৷ আমরা বিইআরসি-র এই প্রক্রিয়ায় গণশুনানি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছি৷’’

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, ‘‘গ্যাসের দাম বাড়ালে পরিবহণ, বিদ্যুৎ, পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে সব খাতে ব্যয় বাড়বে৷ এই বাড়তি ব্যয়ের প্রতিটি অর্থ আবার ব্যবসায়ীরা জনগণের কাছ থেকেই পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে আদায় করবেন৷

ফলে শেষ পর্যন্ত গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির মূল্য সাধারণ মানুষকেই দিতে হবে৷ ৮০ থেকে ৯০ ভাগ মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন আর লাভবান হবেন মাত্র ৫ থেকে ১০ ভাগ মানুষ৷’’ এখন গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিতা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো তো এখনো লাভেই আছে৷ অথচ সরকার তো ব্যবসায়ী না, সরকার জনগণকে সেবা দেবে৷ কিন্তু এখানে হচ্ছে উলটোটা৷

গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিগুলো গত ডিসেম্বরে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বা বিইআরসি-কে৷ মঙ্গলবার, বুধবার ও বৃহস্পতিবার গ্যাস বিতরণ কোম্পানির প্রস্তাবের ওপর গণশুনানি হয়৷ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির পরিপ্রেক্ষিতে দেশে গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়টি অনুমিতই ছিল৷ গত বছরের এপ্রিল থেকে দেশে এলএনজি আমদানি শুরু হয়, যার দাম পড়ছে প্রতি ঘনমিটারে প্রায় ৩০ টাকা৷ এই দর দেশীয় গ্যাসের চার গুণের বেশি৷

এখনো গ্যাসের ঘনমিটার ৭ টাকা ১৮ পয়সা৷ এলএনজির কারণে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার৷ গণশুনানি করে বিইআরসি গ্যাসের দাম কিছুটা বাড়িয়েছিল৷ অবশ্য ভোটের আগে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় গ্যাসের বাড়তি দাম সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপায়নি৷ সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে সেটি সমন্বয় করা হয়৷ ভোটের দু’মাস পর এখন আবার গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে৷

বিতরণকারীরা মূল্যবৃদ্ধির যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা শুনলে যে কেউ আঁতকে উঠবেন৷ এবারের প্রস্তাবে সব ধরনের গ্যাসের দাম গড়ে ১০৩ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, যা অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি৷ দেশে গত ১০ বছরে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে ছ’বার৷ এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ক্যাপটিভ ও যানবাহনের সিএনজির দাম৷ দুই চুলার গ্যাস বিল ছিল ৪৫০ টাকা, যা এখন ৮০০ টাকা৷ নতুন প্রস্তাবে তা ১ হাজার ৪৪০ টাকা করার কথা বলা হয়েছে৷

এক চুলার ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত দর ১ হাজার ৩৫০ টাকা৷ ২০০৮ সালের এপ্রিলে প্রতি ঘনমিটার সিএনজির দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৬ টাকা ৭৫ পয়সা৷ এখন তা ৪০ টাকা, যা বাড়িয়ে ৫৪ টাকা করার কথা বলা হয়েছে৷ নতুন প্রস্তাবে বিদ্যুতে ২০৮ শতাংশ, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৯৬ শতাংশ, শিল্পে ১৩২ শতাংশ ও বাণিজ্যিক খাতে ৪১ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে৷

বিইআরসি-র চেয়ারম্যান মনোয়ার ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা তো কোনো পক্ষ না৷ এখানে আমাদের কোনো স্বার্থও নেই৷ কোম্পানিগুলো যখন প্রস্তাব দেয়, তখন আমাদের তো গণশুনানি করতেই হবে৷ আমরা তো কোম্পানিগুলোর চাহিদা অনুযায়ী দাম বৃদ্ধি করি না৷ শুনানির পর আমাদের কাছে যেটা যৌক্তিক মনে হয়, সেই পরিমাণ দামই আমরা বৃদ্ধি করে থাকি৷’’ এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কথা কতটা বিবেচনায় রাখেন? জবাবে জনাব ইসলাম বলেন, ‘‘অবশ্যই আমরা সাধারণ মানুষের কথা খেয়াল রাখি৷ কিন্তু শুরু অভিযোগ করলে তো হবে না, সবকিছুই চিন্তা করতে হবে৷’’

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়বে রপ্তানি খাত৷ যেসব পণ্যের একটি বড় অংশ দেশে আমদানি হয়, তাদের বিপদটাও কম নয়৷ রপ্তানি খাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে গিয়ে প্রতিযোগিতা সমতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে৷ দেশে উৎপাদন খরচ বাড়লে বাজার পেয়ে যেতে পারে আমদানি পণ্য৷ বিদেশি সুতার সঙ্গে তেমনই এক লড়াই দেশের বস্ত্রকল বা টেক্সটাইল মিলগুলোর৷

গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র সিনিয়র সহ-সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, প্রস্তাবিত হারে গ্যাসের দাম বাড়ালে গার্মেন্টস সেক্টর বিশেষ করে টেক্সটাইল কারখানাগুলো টিকে থাকতে পারবে না৷ বর্তমানে সুতা উৎপাদনের যে খরচ, সেটাই উঠছে না৷ বিদেশি সুতার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা যাচ্ছে না৷ আমাদের তো সুতা আমদানি করতে হয়৷

সেখানে ভারত, চীন, পাকিস্তান নিজেরা সুতা উৎপাদন করে৷ ফলে আমাদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হবে৷ এখানে কিন্তু বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান রয়েছে৷ বিদেশে রপ্তানির আয়ের ৮৩ ভাগই আসে গার্মেন্টস থেকে৷ ব্যাকুয়ার্ড লিংকেজেও বহু মানুষ কাজ করেন৷ ফলে এগুলো খেয়াল রাখা না হলে, বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে৷

প্রসঙ্গত, দেশে এখন দৈনিক মোট গ্যাস সরবরাহ প্রায় ৩২০ কোটি ঘনফুট, যার ৪০ শতাংশই বিদ্যুৎ খাতে ব্যবহৃত হয়৷ গ্যাসের দাম বাড়লে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর দাবি তুলবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)৷ শেষ পর্যন্ত বিদ্যুতের দামের চাপ সাধারণ মানুষের ঘাড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ পাশাপাশি বিদ্যুতের দাম বাড়লে তার প্রভাব শিল্পেও পড়বে৷

এসএইচ-৩১/১৪/১৯ (সমীর কুমার দে, ডয়চে ভেলে)