পাহাড়ের আধিপত্যের রাজনীতিতে খুন!

রাঙামাটিতে ১৪ ঘণ্টা ব্যাবধানে দু’টি ঘটনায় ৮ জনকে হত্যার নেপেথ্যে কি পাহাড়ের আধিপত্যের রাজনীতি? নাকি অন্যকিছু? পুলিশ বলছে, মোটিভ তাদের কাছে পরিস্কার, তবে তদন্তের স্বার্থে এখন তারা প্রকাশ করছেন না৷

রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরেশ কান্তি তঙ্গচঙ্গ্যাকে মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে দুর্বৃত্তরা গুলি করে হত্যা করে৷ উপজেলার আলিক্ষ্যং এলাকায় এই ঘটনা ঘটে৷ আগের দিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে একই জেলার বাঘাইছড়িতে দুর্বৃত্তরা ব্রাশফায়ারে দু’জন নির্বাচন কর্মকর্তাসহ সাতজনকে হত্যা করে৷

রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাজী মুছা মাতব্বর দাবি করেছেন, ‘‘বিলাইছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সুরেশ কান্তি তঙ্গচঙ্গ্যাকে হত্যার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি দায়ী৷ আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার জন্যই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে৷”

সোমবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিলাইছড়ি উপজেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সমর্থিত প্রার্থী বীরোত্তম তঞ্চঙ্গ্যার কাছে পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়সেন তঞ্চঙ্গ্যা৷ হাজী মুছা মাতব্বর দাবি করেন, ‘‘তারা জয়ের পর ওই এলাকায় আওয়ামী লীগ বিনাশে নেমেছে৷’

তবে জনসংহতি সমিতির জেলা সম্পাদক নীলোৎপল খীসা হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার দলের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা এই ধরনের রাজনীতির চর্চা করি না৷ এসব ঘটনার সঙ্গে আমাদের জড়ানোর চেষ্টা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার হীন চেষ্টা৷”

সোমবার রাঙামাটিতে ভোট শেষে ব্যালট বাক্সসহ নির্বাচনি সরঞ্জাম নিয়ে উপজেলা সদরে ফেরার পথে দুর্বৃত্তদের গুলিতে দুই নির্বাচনি কর্মকর্তাসহ সাতজন নিহত হন৷ নিহতদের মধ্যে চারজন আনসার সদস্যও ছিলেন৷ আনসারদের মধ্যে দুই জন নারী৷ সাজেক ইউনিয়নের একটি কেন্দ্রের ফল ঘোষণা শেষে স্থানীয় চান্দের গাড়িতে করে বাঘাইছড়ি উপজেলা সদরে ফিরছিলেন তাঁরা৷ বাঘাইছড়ির নয় মাইল এলাকায় এ হামলার ঘটনা ঘটে৷

স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, বাঘাইছড়ি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)-এর বড়ঋষি চাকমা এবং জনসংহতি সমিতি (এমএন লামা)-র সুদর্শন চাকমা প্রার্থী ছিলেন৷ বাঘাইছড়ি এবং নানিয়ারচরে এম এন লারমার প্রার্থীর সমর্থনে আওয়ামী লগি কোনো প্রার্থী দেয়নি৷ কিন্তু অনিয়মের অভিযোগ এনে সকালে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন জনসংহতি সমিতির বড়ঋষি৷ অপরদিকে জেএসএস এবং ইউপিডিএফ এই নির্বাচনে এক হয়ে কাজ করে৷ ইউপিডিএফ-এর ওই এলাকায় প্রভাব থাকার পরও তারা কোনো প্রার্থী দেয়নি৷ হামলাস্থল নয় মাইল এলাকাটি ইউপিডিএফ অধ্যুষিত৷ তাই এই হামলার জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী করা হচ্ছে৷

ইউপিডিএফ-এর মুখপাত্র মাইকেল চাকমা বলেন, ‘‘আমাদের কেউ এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত নয়৷ আমরা উপজেলা নির্বাচনেও অংশ নেইনি৷ যারা নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, তাদের দ্বন্দ্বের ফলেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে৷ এর দায় সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না৷ যারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত, তারা এখন নিজেদের বাঁচাতে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমাদের ওপর দায় চাপাচ্ছে৷”

রঙামাটি জেলার পুলিশ সুপার আলমগীর কবীর বলেন, ‘‘দু’টি ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি৷ কাউকে গ্রেপ্তারও করা হয়নি৷ নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্ত এবং দাফন কাফন নিয়েই আমরা ব্যস্ত আছি৷”

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘ দু’টি ঘটনাতেই আমরা হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেয়েছি৷ তবে তদন্তের স্বার্থে এখন তা প্রকাশ করব না৷”

তবে তিনি বলেন, ‘‘পাহাড়ে স্থানীয় রাজনৈতিক গ্রুপগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত চলে আসছে৷ বাঘাইছড়ির হত্যাকাণ্ড তারই ধারাবাহিকতা হতে পারে৷ আর বিলাইছড়ির ঘটনায় তো আওয়ামী লীগ নেতারা প্রকাশ্যেই একটি গ্রুপকে দায়ী করেছে৷”

রাঙামাটির সাংবাদিক জিয়াউল হক জিয়া দুটি ঘটনার পরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন৷ হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বলেছেন স্থানীয় লোকজন এবং পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার মনে হয়েছে দু’টি ঘটনাই দীর্ঘদির ধরে চলে আসা স্থানীয় দলগুলোর আধিপত্যের লড়াইয়ের ফল৷ আর দু’টি ঘটনায় জেএসএস এবং ইউপিডিএফ জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে৷”

পাহাড়ে এখন চারটি পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক গ্রুপ সক্রিয়৷ আর এই গ্রুপগুলো সৃষ্টি হয় শান্তি চুক্তির পরে৷ শান্তি চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষ ইস্যুতে ২০০৯ সালে জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরফে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ভেঙে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এমএনলারমা ) নামের আরেকটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে৷

অন্যদিকে, ২০ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের দাবিতে গঠিত ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ২০১৭ সালের নভেম্বরে দুই ভাগ হয়ে যায়৷ নতুন অংশ ইউপিডিএফ-গণতন্ত্র নামে পরিচিতি পায়৷ তারা পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে কিছুটা সরে এসে শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন দাবি করে৷ পাহাড়ে এই চারটি সংগঠন পরস্পরের বিরুদ্ধে সক্রিয়৷ গত ১৫ মাসে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাতে ৫৮ জন নিহত হয়েছেন বলে সংবাদ মাধ্যমের খবর৷ তারা আধিপত্য টিকিয়ে রেখে অর্থনৈতিক কারণে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়৷

আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, ‘‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷ নানা গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে পারস্পরিক সন্দেহ আর অবিশ্বাস৷ পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা মনে করে শান্তি চুক্তি আর বাস্তবায়ন হবে না৷ তাদের মধ্যে এখন গভীর হতাশা৷ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা না দেখে আধিপত্যের সংঘাতে নেমেছে তারা৷”

তিনি বলেন, ‘‘পার্বত্য চট্টগ্রামে এই যে হত্যা, সংঘাত, ১৫ মাসে ৫০টিরও বেশি হত্যাকাণ্ড এর কোনো প্রতিকার ও বিচার হয় না৷ বিচার হয় না নারী নির্যাতন ও অপহরণের৷ এই বিচারহীনতার কারণেও যতই দিন যাচ্ছে পরিস্থিতি ততই খারাপ হচ্ছে৷”

এসএইচ-০৭/২০/১৯ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)