হয়রানিই মূল উদ্দেশ্য নিয়ে মানহানি মামলা

দেশে বেশ কয়েকটি ঘটনায় একই অভিযোগে একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে একাধিক মানহানি মামলা হতে দেখা যায়।

বিপুল অংকের আর্থিক ক্ষতিপূরণের বিষয়টি উল্লেখ দেখা যাচ্ছে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির পরিবর্তে মানহানির মামলা করছে ভিন্ন কোন ব্যক্তি।

অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তার কিরণ এরকম একটি মানহানির মামলায় কারাগারে গিয়ে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। দেশে আইনে মানহানি একই সঙ্গে দেওয়ানি এবং ফৌজদারি অপরাধ।

দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারা বলা হয়েছে মৃত ব্যক্তিরও খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট হয় এমন কোনো বক্তব্য দিলেও মানহানির মামলা হতে পারে।

দণ্ডবিধিতে মানহানির ফৌজদারি মামলা করতে হয় ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। আর ক্ষতিপূরণ চেয়ে দেওয়ানি মামলা করতে হয় সিভিল কোর্টে।

এক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের টাকার দাবির বিপরীতে নির্দিষ্ট অঙ্কের কোর্ট ফি দিতে হয়, যার সর্বোচ্চ পরিমাণ ৫৫-৬০ হাজার টাকা।

দেশে মানহানি মামলা নিম্ন আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে, চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়েছে এমন নজির খুবই কম।

নিম্ন আদালতে যে কোনো একটি মানহানির মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে সেটি খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল ২০০৩ সালের একটি মামলা যেটি চলেছে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে।

২০০৩ সালে যুগান্তর পত্রিকার দায়িত্বে থাকা সম্পাদক প্রয়াত গোলাম সারওয়ার এবং পত্রিকার প্রকাশক ও মালিকের বিরুদ্ধে ৫০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে মানহানি মামলা হয়।

তৎকালীন বিএনপি সরকারের মন্ত্রী মির্জা আব্বাসের করা ফৌজদারি মামলায় ২০১৪ সালে অভিযুক্তদের অব্যাহতি দেয়া হয়।

জানা যায় আর্থিক ক্ষতিপূরণের মামলাটিও আপোষে প্রত্যাহার করে নেন বাদীপক্ষ।

ওই মামলার আসামী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোখলেসুর রহমান বলেন, মানহানির অধিকাংশ মামলারই পরিণতি এমন।

নিম্ন আদালতে দীর্ঘ ৩৩ বছরের আইন পেশার অভিজ্ঞতায় বেশ কয়েকটি মানহানি মামলা পরিচালনার অভিজ্ঞতা মি. রহমান বলেন, এসব মামলায় নিষ্পত্তির হার খুবই কম। মামলা প্রমাণ করাও বেশ কঠিন।

এদিকে গত কয়েক বছরে বিরাট অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির উল্লেখ করে বেশকিছু মানহানির মামলা আলোচনায় এসেছে।

এরমধ্যে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে গত বছর ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতিপূরণ দাবি করে দেশের বিভিন্ন জেলায় ২০টি মামলা হয়।

দু’হাজার ষোল সালে ইংরেজি দৈনিক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে ৭১ হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতিপূরণ চেয়ে সারাদেশে ৬৭টি মানহানি মামলা হয়।

একই বছর সরকারদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফের বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতিপূরণ চেয়ে চট্টগ্রামে দুটি মানহানি মামলা হয়।

এর আগে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধেও মানহানির অভিযোগে মামলা হয় ৩টি যেখানে ৩ হাজার ১শ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়।

এ মামলাগুলোতে বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দাবি থাকলেও মামলাগুলো প্রায় সবই হয়েছে ফৌজদারি আইনে।

দণ্ডবিধিতে মানহানি একটি লঘু এবং আপস-যোগ্য অপরাধ হলেও দেখা যাচ্ছে কাউকে কাউকে মানহানি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জামিন পর্যন্ত জেল খাটতে হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, “বিশ্বব্যাপী যে অ্যাপ্রোচ সেটা হচ্ছে মানহানি একটি সিভিল ক্লেইম। মানহানির কোনো ক্রিমিনাল কেস হওয়াই উচিৎ না। ক্রিমিনাল ল থাকাই উচিৎ না। ধীরে ধীরে এই অ্যাপ্রোচটাই কিন্তু সবচে জোরালো হচ্ছে।”

“যে মামলাগুলো করা হচ্ছে সবকটাই করা হচ্ছে কেবলমাত্র হয়রানি করার উদ্দেশ্যে। জাস্ট সোশ্যাল হ্যারাসমেন্টের টুল হিসেবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখবেন হয়রানি করাটাই মূল উদ্দেশ্য।”

গত প্রায় দুই দশকের অভিজ্ঞতা থেকে মি. বড়ুয়া বলেন, মানহানি বা ক্ষতিপূরণের মামলা বিচার শেষে উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে এমন নজির নেই বললেই চলে।

ফৌজদারি কার্যবিধি ১৯৮ ধারা উল্লেখ করে এ আইনজীবী জানান, মানহানি মামলায় সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি এবং বিশেষ ক্ষেত্রে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি ছাড়া মামলা করার সুযোগ নেই। এছাড়া সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে একটি অপরাধে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা ও দণ্ড সমর্থন করে না। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে একজনের মানহানিতে মামলা ঠুকে দিচ্ছেন অন্যরা।

বড়ুয়া বলছেন, “ক্রিমিনাল কেস হচ্ছে ব্যক্তির বিরুদ্ধে। যিনি সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি তাকেই আসলে গিয়ে অভিযোগটা করতে হয়। সরকারের কোনো কর্তাব্যক্তি বা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে কেউ হয়তো একটা কমেন্ট করে বসলো, দেখা যাচ্ছে কি তার পক্ষ থেকে পার্টির কোনো জেলা লেভেলের বা উপজেলা লেভেলের কোনো নেতা বা কর্মী তিনি মামলা করে দিলেন।

“আদালতের আসলে এ মামলাগুলো নেয়াই উচিৎ না। এই যে প্র্যাকটিসটা চলছে এটাও খুবই একটা ভয়াবহ প্রাকটিস। অনেকগুলো মামলা হওয়া, একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় নেম-ফেমের জন্য পাবলিসিটির জন্য, দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য অসংখ্য মামলা হয়ে যাচ্ছে এটা কমপ্লিটলি ইলিগ্যাল।”

দেশে দণ্ডবিধি ছাড়াও বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মানহানি মামলা হচ্ছে যা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। একই রকম বিতর্ক এবং বিরোধিতা ছিল তথ্য প্রযুক্তি আইনের বিলুপ্ত ৫৭ ধারায় মামলা নিয়ে।

এসএইচ-০৭/২২/১৯ (আবুল কালাম আজাদ, বিবিসি)