ভোট থেকে মানুষের মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে

দেশে নির্বাচন মানেই একসময় ছিল উৎসব। ভোটের আমেজে অন্যসব উৎসবের মত মানুষের মধ্যে উচ্ছলতা ছড়াতো। গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় শহরে নির্বাচন সামনে রেখে চলতো নানা জল্পনা-কল্পনা । কিন্তু হালে সেই নির্বাচন নিয়ে ভোটারদের আগ্রহ কমে গেছে। নির্বাচন সম্পর্কে যেমন মানুষের আগ্রহ নেই তেমনি ভোট দিতে দলবেঁধে আর কেউই কেন্দ্রে যাচ্ছেন না। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ঢাকা-উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) নির্বাচন, আর চলমান উপজেলা পরিষদ নির্বাচন যেন সেই চিত্রকে আরও খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করেছে।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ তুলে দুপুরে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা আসতে থাকে বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের কাছ থেকে। প্রশাসনের পক্ষপাত, ভোটে বাধা দেওয়া, এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া এবং আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখার অভিযোগে নির্বাচন ফল প্রত্যাখান করে বিরোধী দলীয় জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট তথা দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি।এরপর থেকে আর কোন নির্বাচনেই অংশ নেয়নি তারা।

ফলে ডিএনসিসি ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন একরকম সরকার ও তার মধ্যেকার জোটের নির্বাচন হয়ে দাড়ায়। মূলত: ডিএনসিসি নির্বাচন থেকেই ভোটাররা কেন্দ্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। চলমান উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তিনটি ধাপের ভোটেও ভোটারদের দেখা মিলছে না। নির্বাচন ও ভোট থেকে মানুষের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার জন্য সরকার ও প্রশাসনকেই দায়ী করেছেন রাজনীতিক বিশ্লেষকরা।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির কারণে পুরো ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে বলে মানুষের ভেতরে অনীহা আর অনাস্থা তৈরি হয়েছে। মানুষ ভোট দিলে কিছু আসে-যায় না, ভোট দিতে গেলে দিতে পারে না। এই যে ঘটনাগুলোর মধ্যদিয়ে তারা যখন যাচ্ছে, তখন অংশগ্রহণে অনাগ্রহী হয়ে উঠছে। এগুলো গণতান্ত্রিক অবস্থার জন্য অশনিসংকেত। জনগণের মধ্যে যদি সম্মতি সৃষ্টি না হয় সেটা গণতান্ত্রিক হয় না।

মানুষ কেন নিজেকে এই প্রক্রিয়াগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবতে শুরু করল, সেটাও যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করা এবং সমাধানের পথ খোঁজা জরুরি বলে মন্তব্য করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল।

তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলোর প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়েছে। ভোটার কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে যদি ফলাফলে তার প্রতিফলন দেখতে না পান, তাহলে তিনি পরবর্তীতে আর ভোট দিতে যাবেন না এটিই স্বাভাবিক।

‘ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হলে ভোটের আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখার কোনো সুযোগ থাকবে না’ সিইসির এমন বক্তব্যের কথা উল্লেখ করে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সিইসি উপলব্ধি করছেন, নির্বাচনে মান ধরে রাখতে না পারার দায় তাদের ঘাড়েও চাপছে।

নির্বাচন কমিশনের মতো একটি প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা হয়তো তার মনে লেগেছে। গত নির্বাচন নিয়ে শুধু জাতীয় পর্যায় নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও বিরূপ আলোচনা হচ্ছে। ভোটের ওপর মানুষের আস্থা হারাচ্ছে। এখন ইসির উচিত কেন নির্বাচনের মান খারাপ হচ্ছে, তা নিয়ে রিসার্চ করা।

তিনি বলেন, একটি নির্বাচন কমিশনের সফলতা পাওয়ার মূল শর্ত হলো অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেওয়া। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে নির্বাচন কমিশন অনেকটা হালকা হয়ে যায়। ফলে এসব নির্বাচনকে অর্থবহ করতে যেসব কর্মসূচি নেয়া উচিত সেবিষয়ে তাদের ভাবা দরকার।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ৩০শে ডিসেম্বরের নির্বাচন মানুষের মধ্যে একটা অনাস্থা তৈরি করেছে। একারনে বিরোধী সব পক্ষ পরের নির্বাচনগুলো বয়কট করেছে, মানুষও আর এই নির্বাচনে উৎসাহ পাচ্ছে না। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে যেভাবে সরকারীকরণ করা হচ্ছে তাতে করে সেখানে প্রতিনিধি নির্বাচন নয় বরং নিয়োগ করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার ও সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন ছাড়া এই অবস্থা বদলাবে না, মানুষ আগ্রহ পাবেনা। আওয়ামী লীগের লোকজনও বুঝে গেছে নির্বাচন একটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। ফলে তারাও ভোট দিচ্ছে না।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হওয়ায় মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে উল্লেখ করে জোনায়েদ সাকি বলেন, ভোট না দেয়া জনগণের একরকম নীরব প্রতিবাদ।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক মোঃ শাহ আলম বলেন, মানুষ ভোট দিতে গিয়ে দেখছেন তাদের ভোট আগের রাতেই হয়ে যাচ্ছে, এই ভোট দিতে যাওয়া আর না যাওয়া একই অর্থ। মানুষের মধ্যে একটা নেগেটিভ মনস্তত্ব দাড়িয়ে গেছে, তারা আর উৎসাহ পাচ্ছে না। এমনকি আওয়ামী লীগের লোকেরাও ভোট দিচ্ছে না, বিরোধী কেউ নির্বাচনে আসলেও তাদের ভোটাররাও কেন্দ্রে যেতে পাচ্ছে না।

ভোট একসময় উৎসবেরমত ছিলো উল্লেখ করে তিনি বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা দলীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার পর থেকেই এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী না করতে পারলে এই ব্যবস্থা বদলাবে না। এই অবস্থা থাকে কোন নির্বাচনই সুষ্ঠু হবে না।

এদিকে নির্বাচন থেকে মানুষের আগ্রহ কমে গেছে এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহম্মদ ফারুক খান বলেন, উৎসবমুখর ভোট করতে সব রাজনৈতিক দলেরই সদিচ্ছা থাকতে হবে। ভোটার উপস্থিতি কম বলেই যে নির্বাচন থেকে মানুষের আগ্রহ কমে এমন নয় বিষয়টি।

তিনি বলেন, এবারের স্থানীয় সরকার পর্যায়ের নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দলের প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। এসব নির্বাচনে বিরোধীরা না আসায় জনগণ আগে থেকেই ফল বুঝতে পারছে, তারা ভোট দিতে আসছে না। এই দায় শুধু সরকারের নয়। বিরোধীদেরও আছে।

এসএইচ-১৪/২৫/১৯ (অনলাইন ডেস্ক, তথ্য সূত্র : পূর্ব-পশ্চিম)