বিশ্ববাসি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কতটা জানে

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কম-বেশি ১০ হাজার বই বের হয়েছে৷ তবে এর অতি ক্ষুদ্র অংশ রয়েছে ইংরেজি ভাষায়৷ আর ইতিহাস যা হয়েছে তা কতটা নির্মোহ, তা নিয়েও আছে প্রশ্ন৷

২০১৭ সাল থেকে ২৫শে মার্চকে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করছে বাংলাদেশ৷ দেশটিতে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে বাঙালি নিধন শুরু করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী৷ সেই রাতেই মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান৷ এরপর তাঁকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়৷ ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর৷

এরপর থেকে বাংলাদেশ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালন করলেও এই গণহত্যার আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি নেই৷ কেন নেই? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের কাছে৷ জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এটা আমাদের ভুলের কারণেই হয়েছে৷ আমাদের ব্যর্থতাই এর কারণ৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোনো দায় নেই৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি চাইনি৷ আমরা চেয়েছি ২৫শে মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক৷ কিন্তু জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস আগেই ঠিক করে ফেলেছে৷ আমাদের ঘোষণার দু’বছর আগে৷ ৯ ডিসেম্বর হলো ‘ইন্টারন্যাশনাল জেনোসাইড ডে’৷ ১৯৪৮ সালের এই দিনে জাতিসংঘ ‘জোনোসাইড কনভেনশন’ পাশ করেছিল৷”

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২০১৭ সালে এই ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’ পাশ হয়৷ এখন সেটা সংশোধন করে গণহত্যার স্বীকৃতি চাওয়া যায়৷ কিন্তু সেই উদ্যোগ নেই৷ বলা বাহুল্য, গণহত্যার স্বীকৃতি পেতে হলে উদ্যোগটা নিতে হবে সরকারকেই৷ প্রয়োজনীয় ‘ডকুমেন্ট’ এক করতে হবে৷ ব্যক্তি উদ্যোগ নিলে তা থেকে ফল আসার সম্ভাবনা কম৷ কারণ ব্যক্তিকে ‘ভিকটিম’ হিসেবে চিহ্নিত করা হতে পারে৷

শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘‘উদ্যোগ নিলে অবশ্য পাকিস্তান বিরোধিতা করবে৷ অ্যামেরিকা এবং চীনও বিরোধিতা করতে পারে৷ সেজন্যও আমাদের কাজ করতে হবে৷ কোনো দেশ বিরোধিতা করলে সেই দেশের মানুষের সমর্থন নিতে হবে৷ কিন্তু সেই উদ্যোগ কেথায়?”

বাংলাদেশের গণহত্যার ‘ডকুমেন্ট’ বিভিন্ন দেশের সরকার ও সরকারপ্রধানদের কাছে তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোকে দায়িত্ব দেয়া হয়৷ কিন্তু তার কোনো অগ্রগতি নেই৷ তবে এগুলো শুধু দূতাবাসের কাজ নয়, এর জন্য প্রয়োজন জাতীয় ভিত্তিতে কাজ করা৷

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার জন্য আমরা কী যথেষ্ঠ গবেষণা ও কাজ করছি? জবাবে শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধ তো একটি বিস্তৃত এবং বড় বিষয়৷ এছাড়া ইতিহাস রাষ্ট্রীয়ভাবে কতটা হবে, তাও বোঝার বিষয় আছে৷ তবে রাষ্ট্র এর পৃষ্টপোষকতা করবে৷ যেমন আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী পালন করতে যাচ্ছি৷ কিন্তু আমাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর কোনো ‘অফিসিয়াল’ জীবনী নেই৷”

প্রশ্ন উঠেছে, বাইরের দেশের অথবা ভিন্ন ভাষার কেউ যদি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে চান, তাহলে কীভাবে জানবেন? তাঁদের জানার জন্য বাংলাদেশে কী ব্যবস্থা আছে? তাঁরা কোথায় যোগাযোগ করবেন? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক বড় কাজ করছে৷ বাংলা একাডেমি মুক্তিযুদ্ধের জেলা ও সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস প্রকাশ করেছে৷ সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বই প্রকাশ করেছে৷ যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার ওপর আলাদা গবেষণা আছে, ব্যক্তিগত ও বেসরকারি উদ্যোগে৷ মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রও সংকলিত হয়েছে৷ কিন্তু সেটা বিশ্বের কাছে পৌঁছবে কীভাবে?

মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গেলে কোনো বিদেশি নাগরিকের পক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে একটি মোটামুটি ধারণা পাওয়াও সম্ভব নয়৷ ফলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের আবেগ থাকলেও, বিশ্বের কাছে তা তুলে ধরার জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই৷

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক আফসান চৌধুরী মনে করেন, ‘‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা খুবই কম হয়েছে৷ যা হয়েছে তা হল কেউ হয়ত তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন৷ অথবা কেউ হয়ত তাঁর রাজনৈতিক চিন্তা থেকে লিখেছেন৷ আবার কেউ কেউ নিজের স্মৃতিকথা লিখেছেন৷ বীরত্বগাঁথা লিখেছেন৷ এগুলো গবেষকদের কাজে লাগতে পারে৷ ইতিহাসের জন্য প্রয়োজন হতে পারে৷ কিন্তু এগুলো তো গবেষণা বা ইতিহাস নয়৷ মুক্তিযুদ্ধর ওপর আমাদের হয়ত ১০ হাজার বই হয়ে গেছে৷ তার মধ্যে আমি বলবো সাড়ে ৯ হাজার বইকে আমরা গবেষণামূলক বই বলতে পারব না৷ এছাড়া বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে আমাদের ইংরেজি এবং আরো অনেক ভাষায় মুক্তিযুদ্ধের বই প্রয়োজন৷ আমার হিসেবে ইংরেজিতে বইয়ের সংখ্যা ০ দশমিক ৫ ভাগ৷”

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অনেক বিদেশি কাজ করেছেন৷ তাঁরা নিজ নিজ দেশে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন৷ তহবিল সংগ্রহ করেছেন৷ কনসার্টের আয়োজন করেছেন৷ বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলো প্রচুর সরেজমিন প্রতিবেদন করেছে৷ তৈরি হয়েছে প্রামান্য চিত্র৷ কিন্তু পরে আর এই আগ্রহটা জাগিয়ে রাখা যায়নি৷ বিদেশি গবেষকরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণায় তেমন আগ্রহী হননি৷ আর ইংরেজিতে যেসব বই আছে, তার একটি অংশ বিদেশিদের৷

তবে তাঁরা গবেষক হিসেবে নয়, কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত৷ তাঁরা যা লিখেছেন তার সব কিছু প্রামান্য কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে৷ আফসান চৌধুরী বলেন, ‘‘আমার মনে হয় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বিদেশি লেখকের লেখা একমাত্র বই, যা সবচেয়ে বেশি পঠিত হয়েছে৷ তবে সেই বইয়ে জগন্নাথ হলের আক্রমণের ঘটনাকে যৌক্তিকতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে৷ এরমধ্যে অনেক অসত্য তথ্য রয়েছে৷ বইটি আচার্ড ব্লাড লিখেছেন৷ আমরা সেটা বিশ্লেষণ করতে চাইনা৷ গ্রহণ করতে চাই, কিন্তু পারছি না৷ আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের মতো করে লিখলে চলবে না৷ গবেষণা আবেগের বিষয় নয়, জাতীয়তাবাদের বিষয় নয়৷ সেটা আমরা এখনো বুঝতে পারছি না৷ তাছাড়া বাংলায় লিখলে বিদেশিরা কীভাবে পড়বেন?”

বাংলাদেশে গত ৪৮ বছরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মাত্র ৪০টি পিএইচডি গবেষণা হয়েছে৷ এর মধ্যে ৩৫টি হয়েছে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে৷ বাংলাদেশিরা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাঁচটি পিএইচডি করেছেন বলে সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা যায়৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জোনোসাইড স্টাডিজ’ বিভাগের একটি প্রকল্প হলো ছাত্র-ছাত্রীদের সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া৷ তাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় এলাকায় নিয়ে যাওয়া৷ সেই প্রকল্পে কাজ করছেন মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সাংবাদিক অজয় দাসগুপ্ত৷ তিনি বলেন, ‘‘ইংরেজিতে কিছু কাজ হয়েছে৷ বাংলা একাডেমির সব কাজই ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে৷ কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে ইংরেজিতে লিখেছেন৷ কিন্তু বিশ্ববাসীর কাছে এটা তুলে ধরার জন্য ইংরেজিসহ নানা ভাষায় যে প্রকাশ করার বিষয়টা, সেটা হয়নি৷ তবে এখন সেটা করার সময় এসেছে৷”

তিনি বলেন, ‘‘এর জন্য শুধু সরকারি নয়, সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন৷ আর একটা কাজ সহজেই হতে পারে৷ বাংলাদেশের গবেষক বা ছাত্র, যাঁরা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা ও গবেণা করেন, তাঁদের বৃত্তির বিনিময়ে কাজে লাগানো যেতে পারে৷ সবই যে বই আকারে ছাপতে হবে, তা নয়৷ কারণ এখন এগুলো অনলাইনেও প্রকাশ করা সম্ভব৷ বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে বসে যে কেউ অনলাইনে তা করতে পারেন৷”

তবে এই কাজটা করতে হবে বিশ্বস্ততার সাথে৷ সততার সাথে, সঠিক গবেষণা পদ্ধতি মেনে৷ আবেগ এবং শুধু জাতীয়তাবাদের বীরত্বের কাহিনি প্রকাশ করলে তা বিদেশিদের আগ্রহ তৈরি করতে নাও পারে৷ ইতিহাস রাজনৈতিক না হয়ে হতে হবে গণমানুষের৷ আফসান চৌধুরী কথায়, ‘‘আমি কী লিখতে পারব আর কী পারব না তা যদি নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়, তাহলে তো বেশি দূর এগোনো যাবে না৷”

এসএইচ-১১/২৬/১৯ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)