মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারি পদক্ষেপ কাজে লাগছে না?

দেশে কক্সবাজারের টেকনাফে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি’র একটি টহল দলের সাথে কথিত বন্দুক যুদ্ধে সন্দেহভাজন দুজন মাদক পাচারকারী নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

এই নিহতরা মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থী বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। পুলিশ বলেছে, নিহতদের সাথে প্রায় দুই লাখ ইয়াবা ছিল।

গত বছরের মে মাস থেকে ইয়াবাসহ মাদক বিরোধী অভিযানে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে বন্দুক যুদ্ধে সন্দেহভাজন অনেকে নিহত হয়েছে। এরই মাঝে টেকনাফে একশ’র বেশি ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করেছে।

এরপরও সেখানে বন্দুক যুদ্ধে সন্দেহভাজনদের নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে।

তাহলে অবৈধ মাদক পাচারের বিরুদ্ধে সরকারের পদক্ষেপ কি প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল পাচ্ছে না, এই প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে।

টেকনাফে সর্বশেষ কথিত বন্দুক যুদ্ধে দু’জন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে বুধবার ভোররাতে।

সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি’র বক্তব্য হচ্ছে, মিয়ানমার থেকে নাফ নদী দিয়ে ইয়াবার একটি বড় চালান বাংলাদেশে ঢুকছে, এমন খবর পেয়ে বিজিবির টহল দল অভিযানে যায়।তখন সন্দেহভাজনরা গুলি ছুঁড়লে বিজিবি পাল্টা গুলি চালায় এবং গোলাগুলিতে প্রায় দুই লাখ ইয়াবা বহনকারী দু’জন রোহিঙ্গা নিহত হয়।

যদিও গত ১৬ই ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে টেকনাফে এক সমাবেশে অবৈধ মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত ১০২জন আত্মসমর্পণ করেছে এবং তারা কারাগারে রয়েছে।

এরপরও সেখানে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে কথিত বন্দুক যুদ্ধে সন্দেহভাজনদের নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটছে।

টেকনাফ থেকে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার শিউলি শর্মা বলছিলেন, ইয়াবাসহ মাদক পাচারকারী গডফাদাররা এখন কৌশল পাল্টিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

“ইদানীং মেয়েদেরকে এখানে মাদক পাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা নারীদের এই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা ধরা পড়ছে, ওরা শুধু বহনকারী মাত্র।”

অবৈধ মাদক ব্যবসায়ীদের একটা অংশের আত্মসমর্পণের ঘটনাকে সরকার বা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটা বড় সাফল্য হিসেবে দেখানো হচ্ছে।

তবে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এই আত্মসমর্পণের ঘটনার আগ পর্যন্ত মাদক বিরোধী অভিযানে কক্সবাজারে সন্দেহভাজন ৪৭ জন নিহত হয় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে বন্দুক যুদ্ধে। আর এরপর থেকে এ পর্যন্ত বন্দুক যুদ্ধে ১২জন নিহত হয়েছে।

মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকের আত্মসমর্পণের পরও বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।

তবে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন দাবি করেছেন, তাদের পদক্ষেপের কারণে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসা অনেক কমেছে।

“যারা আত্মসমর্পণ করেছে ১০২জন, এরা ছিল বড় মাপের ব্যবসায়ী। এখনও তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকে আত্মসমর্পণ করে নাই। তার বাইরেও আমরা আগে অনেক ব্যবসায়ীকে আইনের আওতায় আনতে পারিনি। তাদের ব্যাপারে তথ্য আমাদের কাছে কম ছিল।”

“যারা আত্মসমর্পণ করেছে, তাদের কাছ থেকে আমরা অনেক তথ্য পেয়েছি, নতুন নতুন নাম পেয়েছি এবং এখানে তাদের একটা বড় সহযোগী ছিল হুন্ডি ব্যবসায়ী।তাদেরকেও আমরা চিহ্নিত করেছি। এখন যে ব্যবসাটা চলে, আপনি যদি পুলিশ সহ সব সংস্থার উদ্ধার দেখেন, তাহলে দেখবেন, এই রুট দিয়ে ইয়াবা প্রবেশ প্রায় ৮০ভাগ বন্ধ হয়েছে।”

মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচার হয়ে আসার প্রধান রুট হিসেবে কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়াকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। এই ইয়াবা চলে যাচ্ছে সারাদেশে।

গত বছরের ৪ঠা মে থেকে ইয়াবাসহ অবৈধ মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। আর বন্দুক যুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটনা ঘটতে থাকে ১৯শে মে থেকে।

এই অভিযানে সারাদেশে এ পর্যন্ত বন্দুক যুদ্ধে ৩২১ জন নিহত হয়েছে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হিসাবে তা জানা গেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মসমর্পণ বা অভিযান অব্যাহত রাখার ঘটনার পরও ইয়াবাসহ অবৈধ মাদক পাচার বা এর ব্যবসার প্রত্যাশা অনুযায়ী কমেনি।

অবৈধ মাদক ব্যবসা এবং পাচার নিয়ে কাজ করেন অধ্যাপক এমদাদুল হক।তিনি বলছিলেন, সরকারের পদক্ষেপে ঘাটতি থাকার কারণে তা ব্যর্থ হচ্ছে।

“একটা প্রতীকী আত্মসমর্পণ হয়েছে। অভিযানও চলছে।কিন্তু এর প্রভাবটা সেভাবে আসছে না। এটার জন্য সামগ্রিকভাবে যে লড়াই বা যে কমিটমেন্টের ব্যাপারটা,কোনো কিছুর ছাড় না দেয়া।এটা প্রশাসনের ক্ষেত্রে হোক বা রাজনীতির ক্ষেত্রে হোক বা সিন্ডিকেটদের ক্ষেত্রে হোক যে কোনো ছাড় দিয়ে কাজ করা। এই প্রত্যয়ের ক্ষেত্রে কিছুটা ঘাটতি আছে। এর সুযোগ নিচ্ছে সিন্ডিকেটের লোকজন।”

বিশেষজ্ঞরা এটাও বলছেন, কথিত বন্দুক যুদ্ধের ঘটনা দিয়ে শুধু অবৈধ মাদক ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব নয়।

কিন্তু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ ব্যর্থতার অভিযোগ মানতে রাজি নন। তিনি উল্লেখ করেছেন, মাদক বিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে।

“বন্ধ তখন হবে, যখন মাদক ব্যবসায়ীরা বন্দুক ব্যবহার বন্ধ করবে। মাদক ব্যবসায়ীরা যেভাবে বন্দুক হস্তগত করেছে।তারা যদি বন্দুক ব্যবহার করে, তাহলে আত্মরক্ষার্থে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও এরকম কার্যক্রম করতে হয়।”

তিনি আরও বলেছেন, “এটি আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, এখন মাদক সহজে পাওয়া যাচ্ছে না। এছাড়া যে হারে মাদকাসক্তি বেড়ে যাচ্ছিল। কেউ বলছেন ৩৬ লক্ষ, আবার কেউ বলছেন যে, ৭০ লক্ষ মাদকাসক্ত বাংলাদেশে তৈরি হয়েছিল। এটা বাংলাদেশের জন্য একটা বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি করছিল।সেখান থেকে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে আমরা মনে করি।”

এসএইচ-০৫/২৮/১৯ (কাদির কল্লোল, বিবিসি)