যেভাবে চরমপন্থায় রূপ নেয় উগ্র বাম আন্দোলন

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলো এক সময় বিভিন্ন চরমপন্থী গ্রুপের অভয়ারণ্য হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৬০’র দশক থেকে ওই অঞ্চলে বিভিন্ন বামপন্থী দল তাদের তৎপরতা শুরু করে এবং তখন তাদের মূল ভিত্তি ছিল ‘মার্কসবাদ’ এবং ‘মাওবাদী’ আদর্শ।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, মেহেরপুর এবং চুয়াডাঙ্গা জেলায় এসব গ্রুপের তৎপরতা বাড়তে থাকে।

এসব সংগঠন গোঁড়া থেকেই অতি বাম আদর্শে বিশ্বাস করতো। তবে বামপন্থী আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে অপরাধ প্রবণতার সাথে জড়িয়ে পড়ে সংগঠনগুলো।

আদর্শের দ্বন্দ্ব কিংবা আর্থিক ভাগাভাগি নিয়ে চরমপন্থী সংগঠনগুলোর মধ্যে ক্রমাগত বিভেদ এবং এর ফলাফল হিসেবে নানা উপদল সৃষ্টি হতে থাকে।

অভিযোগ রয়েছে, নিজেদের প্রতিপক্ষকে অবলীলায় খুন করতেও দ্বিধা করতো না এসব চরমপন্থী গ্রুপের সদস্যরা।

দিনের আলোয় প্রকাশ্যে কাউকে হত্যা করা ছিল বিভিন্ন চরমপন্থী গোষ্ঠীর কাজের অন্যতম ধরণ।

উগ্র বাম এসব সংগঠনের কর্মকাণ্ড ১৯৬০’র দশক থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক।

অধ্যাপক হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বাংলাদেশ যখন প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থায় একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখা দেয়। এই অবস্থার মধ্যে কয়েকটা মার্কসবাদী গ্রুপ আত্মপ্রকাশ করে। এর মধ্যে কিছু গ্রুপ ছিল যারা শত্রুদের গুপ্তহত্যার মাধ্যমে আতঙ্ক সৃষ্টি করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করবে।”

চরমপন্থী গ্রুপগুলো শেষ পর্যন্ত জনসমর্থন পায়নি। তবে তাদের ভয়ে আতঙ্কিত থাকতো সাধারণ মানুষ।

আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, পুরনো কমিউনিস্ট নেতারা দৃশ্যপট থেকে বিদায় নেওয়ার পর এসব চরমপন্থী সংগঠন কার্যত মনোনিবেশ করে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে, যার মাধ্যমে তারা অর্থ উপার্জন করতে পারে।

“যারা এ ধরণের চরমপন্থী, তারা তাদের রাজনৈতিক আদর্শের কথা বলছে বটে, কিন্তু আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হলো। … এইভাবে শত্রুদের হত্যা করার মাধ্যমে পৃথিবীর কোন দেশেই এ রকম শক্তি টিকতে পারেনি। জনগণ ভয় পেয়েছে। এই কর্মপদ্ধতিতে কেউ সফল হয়নি। এরা যদি ১০ জনকে মারে, পুলিশ তাদের ১০০ জনকে মারবে।”

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলায় অপরাধ তৎপরতা ঠেকানো জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৯ সালে চরমপন্থী গ্রুপগুলোর জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। সে সময় চরমপন্থী দলের প্রায় ৭০০ সদস্যকে আনসার বাহিনীতে অস্থায়ী ভিত্তিতে চাকরীও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অনেকে চাকরী ছাড়েন কয়েক বছরের মধ্যেই।

১৯৯৯ সালে আত্মসমর্পণের পরেও চরমপন্থী গ্রুপগুলোর তৎপরতা অব্যাহত ছিল। কিন্তু দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকে ২০০৪ সালে বিশেষ বাহিনী র‍্যাব গঠনের পর থেকে।

র‍্যাব এবং পুলিশের হাতে চরমপন্থী দলের কয়েকশ’ সদস্য নিহত হয়। যদিও র‍্যাব এবং পুলিশ দাবি করে যে অভিযানের সময় এরা ক্রসফায়ারে মারা যায়।

সবচেয়ে সাড়া জাগানো ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ছিল মোফাখখার চৌধুরী। তিনি ছিলেন গোপন রাজনৈতিক দল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির একজন শীর্ষ নেতা। ২০০৫ সালে ঢাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে র‍্যাব। পরবর্তীতে র‍্যাব-এর তরফ থেকে জানানো হয় যে মি. চৌধুরী ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন।

মোফাখখার চৌধুরী নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় বেশ কিছু বৃদ্ধিজীবী।

এছাড়া ২০০৮ সালে কুষ্টিয়ায় র‍্যাবের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল জনযুদ্ধ ) শীর্ষ নেতা আব্দুর রশিদ মালিথা, যিনি দাদা তপন নামে পরিচিত ছিলেন।

২০০৮ সালে পুলিশের সাথে আরেকটি কথিত বন্দুক যুদ্ধের ঘটনায় নিহত হন নিষিদ্ধ সংগঠন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এম এল – লাল পতাকা) শীর্ষ নেতা ডা. মিজানুর রহমান টুটুল।

মিজানুর রহমান টুটুল আটক হবার পরপরই তার মা নভেরা খাতুন এক সংবাদ সম্মেলনে আকুতি জানিয়েছিলেন যে তার ছেলেকে যেন ‘ক্রসফায়ারে মারা না হয়’।

চরমপন্থী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু নেতা নিহত হওয়ার পর থেকে ওইসব সংগঠনের প্রকাশ্য তৎপরতা খুব একটা দেখা যায়নি।

তবে এসব সংগঠন একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো বলে যে ধারণা ছিলো, মঙ্গলবারে পাবনায় কয়েকশো’ চরমপন্থীর আত্মসমর্পণের ঘটনা তা ভুল প্রমাণ করে।

পাবনায় আত্নসমর্পণকারী চরমপন্থীরা কারা?

দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে চরমপন্থী তৎপরতা স্তিমিত হয়ে এলেও উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় তাদের তৎপরতা এখনো চোখে পড়ার মতো। এসব জেলার মধ্যে রয়েছে পাবনা, রাজশাহী এবং নওগাঁ।

পাবনার স্থানীয় সাংবাদিক আহমেদ হুমায়ুন তপু জানিয়েছেন, মূলত চারটি চরমপন্থী সংগঠনের প্রায় ছয়শো’ জন আত্মসমর্পণের করেছে। এসব সংগঠন হচ্ছে – পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এম এল – লাল পতাকা), নিউ পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি এবং কাদামাটি।

চরমপন্থী সংগঠনের যেসব সদস্য আত্মসমর্পণ করেছেন, তাদের মধ্যে ১৬০ জন পাবনা জেলার বাসিন্দা। এছাড়া ৮০ জন রাজশাহীর বাগমারার বাসিন্দা বলে জানা যাচ্ছে।

এসএইচ-১৩/০৯/১৯ (আকবর হোসেন, বিবিসি)