সেই হত্যা মামলাগুলো আলোচনায় এসেছে

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির মৃত্যুর পর নতুন করে আলোচনায় এসেছে হারিয়ে যাওয়া সেই হত্যা মামলাগুলো৷ উচ্চ আদালত থেকে বলা হয়েছে, মিতু, তনু বা সাগর-রুনি’র মতো নুসরাতের মামলাটা যেন হারিয়ে না যায়, সেদিকে নজর রাখা হবে৷

নুসরাত হত্যাকাণ্ডের মামলাটির বিচার বিভাগীয় তদন্ত চেয়ে এক আর্জির পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘আমরা যতটুকু জানি যে এ মামলা পিবিআইতে ট্রান্সফার করা হয়েছে তদন্তের জন্য৷ প্রধানমন্ত্রী নিজে এটা তদারক করছেন৷ তারপরও আমরা সমভাবে ব্যথিত৷ আমরা কোনোভাবেই চাই না সাগর-রুনির মতো, মিতুর মতো, তনুর মতো এ মামলাটা হারিয়ে যাক৷”

বিচার বিভাগীয় তদন্তের আর্জি জানানো আইনজীবী সাইয়্যেদুল হক সুমনকে উদ্দেশ্য করে বিচারক বলেন, ‘‘আপনারা খেয়াল রাখেন৷ আমরাও খেয়াল রাখছি৷ তদন্তের কোনো জায়গায় কোনো কারণে যদি মনে হয় গাফিলতি আছে, আপনারা চলে আসবেন, আমরা ইন্টারফেয়ার (হস্তক্ষেপ) করব৷”

পুলিশের একজন উপপরিদর্শককে (এসআই) তদন্তের ভার না দিয়ে হাইকোর্টে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ চেয়েছিলেন জানিয়ে আইনজীবী সুমন সাংবাদিকদের বলেন, এ ঘটনায় বড় বড় দলের নেতারা থাকতে পারেন৷ ধর্মীয় অনুভূতির ব্যাপার থাকতে পারে৷ পুরো দেশের মানুষ বসে আছে এ ঘটনার একটা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দেখার জন্য৷

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘‘প্রতিবছর চার হাজার হত্যাকাণ্ড হয়৷ ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে ৩৮ হাজার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ কয়টা ঘটনার রহস্য উন্মোচন করেছে পুলিশ? বহু মামলাই এভাবে হারিয়ে গেছে৷ যেগুলো নিয়ে মিডিয়ায় একটু বেশি লেখালেখি হয়, সেটা আলোচিত মামলা৷ পুলিশ পারে ঘরের মধ্যে স্ত্রীকে হত্যা করল স্বামী, ভাই ভাইকে হত্যা করল, এই সব মামলার রহস্য উৎঘাটন করতে৷ যেখানে একটু কষ্ট করে অপরাধী বের করতে হয়, সেখানে আর পারে না৷

বলা হয়, জঙ্গি তৎপরতা রোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সফল৷ কিন্তু দেশে কত জঙ্গি ছিল? সর্বোচ্চ ৫০ জন? তাদের তো মেরেই ফেলেছে৷ আবার উলটো দিক দিয়ে দেখলে দেখবেন, পুলিশ কী করবে? একজন এসআইয়ের কাঁধে ২৫টি মামলা৷ সে কোন মামলার তদন্ত করবে? পুলিশের তো প্রটোকল দিতেই সময় চলে যাচ্ছে৷ কয়জন পুলিশ সঠিকভাবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন?”

হারিয়ে গেছে শিক্ষিকা অঞ্জলী দেবী হত্যার ঘটনা ২০১৫ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের চকবাজার তেলিপট্টি এলাকার নিজ বাসার গলির মুখে অঞ্জলি দেবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়৷ তিনি চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছিলেন৷

এই ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় যুবকদের আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা করেন তাঁর স্বামী ডা. রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী৷ প্রথমে মামলাটি তদন্ত করেন পাঁচলাইশ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল মোতালেব৷ পরে মামলাটি তদন্ত শুরু করে নগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ৷

এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়া মাদ্রাসার সাবেক ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মোহাম্মদ রেজাকে গ্রেফতার করা হয়৷ পরে তিনি জামিনে মুক্তি পান৷ নার্সিং কলেজে ছাত্রীদের হিজাব পরা নিয়ে আন্দোলনের সময় অঞ্জলি দেবীকে আইনি নোটিশ দিয়েছিলেন রেজা৷

অঞ্জলী দেবীর স্বামী রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুলিশ আসামিদের খুঁজে পায় না, শুধু বারবার আমাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে৷ আমি তাদের পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছি, যেভাবে হত্যাকাণ্ডটি হয়েছে, তাতে আমার মনে হয়েছে এটা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর কাজ৷ পরিষ্কারভাবে পুলিশকে সেই কথাটি বলেছি, কিন্তু তারা কিছুই করেনি৷”

মিতু হত্যা মামলার তদন্ত অনিশ্চিত

২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রামের জিইসির মোড় এলাকায় ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন মাহমুদা খানম মিতু৷ এ ঘটনার পর তাঁর স্বামী বাবুল আক্তার বাদি হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন৷

অস্ত্র আইনের মামলাটি বিচারাধীন থাকলেও মাহমুদা হত্যা মামলায় এখনো অভিযোগপত্র জমা দেয়নি গোয়েন্দা পুলিশ৷ এই মামলায় ভোলা গত ১৩ মে হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন৷ এখন এই মামলায় কারাগারে কেউ নেই৷

মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছেন ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুজ্জামান৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘তদন্ত নিজস্ব গতিতে চলছে৷ এই মুহূর্তে কোনো অগ্রগতি নেই৷ এর বেশি কিছু বলা যাবে না৷”

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ২৭ জুন চট্টগ্রামের বাকলিয়া এলাকা থেকে মাহমুদা হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র-গুলিসহ ভোলা ও তাঁর সহযোগী মো. মনিরকে গ্রেপ্তার করে ডিবি৷ অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় ওই বছরের ২৮ জুলাই বাকলিয়া থানার পুলিশ দু’জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়৷ কিন্তু মিতু হত্যা মামলার কোনো সুরাহা হচ্ছে না৷

অনিশ্চিত গন্তব্যে তনু হত্যা মামলা

২০১৬ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরে টিউশনি করাতে গিয়ে আর বাসায় ফেরেননি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু৷

অনেক খোঁজাখুঁজির পর রাতে তনুদের বাসার অদূরে সেনানিবাসের ভেতরের একটি জঙ্গলে তাঁর মরদেহ পায় স্বজনরা৷ পরদিন তাঁর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহায়ক ইয়ার হোসেন বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা ঘাতকদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন৷

থানা পুলিশ ও ডিবির পর ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল থেকে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি৷ ২০১৭ সালের মে মাসে সিআইডি তনুর জামা-কাপড় থেকে নেওয়া নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করে তিনজন পুরুষের শুক্রাণু পাওয়ার কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল৷ পরে সন্দেহভাজনদের ডিএনএ ম্যাচিং করা হলেও রিপোর্ট আসেনি৷

মামলাটি বর্তমানে তদন্ত করছেন সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জালাল উদ্দিন আহমেদ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘ম্যাচিং রিপোর্ট এখনো পাইনি৷ আমরা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি৷ রিপোর্ট পেলে তখন বলা যাবে৷” কখন রিপোর্ট আসবে? সে ব্যাপারেও কিছু বলতে পারেননি জালাল উদ্দিন৷

কুলকিনারা হয়নি ত্বকী হত্যা মামলার

২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জের শিক্ষার্থী তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে অপহরণ ও খুন করা হয়৷ ৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা চারারগোপ এলাকার খাল থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়৷ এই হত্যাকাণ্ডের পর দেশজুড়ে আলোচনা পড়ে যায়৷ অভিযোগের আঙুল উঠে নারায়ণগঞ্জের একটি অভিজাত পরিবারের দিকে৷ ক্ষমতাশালী হওয়ার কারণে তাদের কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি৷

কিছুদিন আগে ত্বকীর মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেছেন, ‘‘যে-কোনো কারণেই হোক এই বিচার পিছিয়ে যাচ্ছে৷ আমরা এটি চাই না৷ সাত খুনের হত্যার যদি বিচার হতে পারে, তাহলে ত্বকী হত্যার বিচার নয় কেন? ত্বকীকে যারা হত্যা করেছে, সেই পরিবারের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস নারায়ণগঞ্জের অনেকের ছিল না৷

ত্বকী হত্যার প্রতিবাদে মঞ্চ করে আমরা প্রতিবাদ করতে পারছি৷ অনেকে ভেবেছিল, ত্বকীকে হত্যা করে নারায়ণগঞ্জ স্তব্ধ হয়ে যাবে৷ কিন্তু নারায়ণগঞ্জ তো স্তব্ধ হয়নি৷ বরং সারা বিশ্ব, বাংলাদেশ প্রতিবাদ করেছে৷ প্রধানমন্ত্রীর কাছে কোনো বাধাই বাধা নয়, কোনো কৌশলগত কারণে হয়তো তিনি বিচার করছেন না৷ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তিনি এর বিচার করবেন৷”

গন্তব্যহীন সাগর-রুনি হত্যা মামলা

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি সাংবাদিক দম্পতিকে ঢাকায় পশ্চিম রাজাবাজার এলাকায় তাঁদের বাসায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়৷ ঘটনার সময় ঐ বাসায় থাকা তাঁদের একমাত্র শিশু সন্তান মাহি সরওয়ার মেঘ বেঁচে যায়৷ হত্যাকাণ্ডের পর সাত বছরে তদন্তে অগ্রগতি নেই৷ এমন পরিস্থিতিতে সান্ত্বনা পাওয়ার পথও খুঁজে পাচ্ছে না সাংবাদিক দম্পতির বিপর্যস্ত পরিবার দু’টো৷

মেহেরুন রুনির ভাই নওশের রোমান বলছিলেন, তাঁদের মাঝে একদিকে রয়েছে শূন্যতা, অন্যদিকে হতাশা তৈরি হচ্ছে৷ তিনি বলেন, মেঘ বড় হচ্ছে৷ সে যখন বুঝতে তার মা-বাবাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু বিচার হয়নি৷ তখন তার মানসিক অবস্থা কী হবে, সেটা নিয়েই সবাই শঙ্কিত৷ এই মামলাটির আদৌ কোনো কুল-কিনারা হবে কিনা তা নিয়ে সাংবাদিক মহলে রয়েছে হতাশা৷

এসএইচ-০৬/১৩/১৯ (সমীর কুমার দে, ডয়চে ভেলে)