দেশের রাজনীতি এখন কার হাতে সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে৷ বিশ্লেষকরা বলছেন রাজনীতি এখন আর রাজনীতিবিদ এবং সাধারণ মানুষের হাতে নেই৷ আর সিদ্ধান্ত গ্রহণেও তাদের ভূমিকা গৌণ হয়ে গেছে৷ তাহলে কারা সিদ্ধান্ত নেন?
দেশে ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের পরে এই প্রশ্ন আরো বড় হয়ে দেখা দিয়েছে৷ সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া আর বিএনপি’র সংসদে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্তের মূলসূত্র বিষয়টিকে আলোচনায় নিয়ে এসেছে৷ একটি কথা এখন প্রায়ই শোনা যায় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ না দিলে কিছু হয় না৷ আর দল হিসেবে বিএনপি’র সিদ্ধান্ত নেয়ার আদৌ কোনো ক্ষমতা আছে কিনা৷ ব্যক্তিনির্ভরতার রাজনীতির এই ধারায় ব্যক্তি আসলে কাদের নিয়ে সিদ্ধান্ত নেন? তারা কি রাজনীতিবিদ?
বাংলাদেশের রাজনীতির পর্যবেক্ষক এবং গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, ‘‘কোনো দলের রাজনীতিই আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই৷ এর নিয়ন্ত্রক এখন সিভিল ও মিলিটারি ব্যুরোক্রেসি এবং বিত্তশালীরা৷ আর সাধারণ মানুষও রাজনীতিতে নেই৷ তাদের গুরুত্বও নেই৷ ফলে যা হবার হয়েছে৷ রাজনীতি চলে গেছে রাজনীতিবিদদের হাতের নাগালের বাইরে৷”
তিনি বলেন, ‘‘রাজনীতি বিষয়টি একটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন৷ শাসন করার ক্ষমতা যার হাতে তিনি রাজনীতিবিদ৷ রাজনীতি শাসন করে৷ আর সেই দিক থেকে রাজনীতিকে বিবেচনা করলে বোঝা যাবে রাজনীতি কার হাতে৷ এটা স্পষ্ট যে শাসন করার ক্ষমতা এখন আর একক কারুর হাতে না৷ এটা নানা গ্রুপের হাতে ভাগ হয়ে গেছে৷”
আফসান চৌধুরীর মতে যারা শাসন করেন তারা হলো:
১. সবার উপরে আছে সেনাবাহিনী৷ তারা সবচেয়ে সবল৷ এটা সারা দুনিয়ায়ই এখন একই রকম৷
২. ব্যবসায়ী শ্রেণি৷ একটি শ্রেণি গত ৫০ বছরে উপরে উঠে এসছে৷ মন্ত্রীই বলেছেন ব্যাংকের টাকা মেরে দিলে তা ফেরত আনা সম্ভব নয়৷ তাহলে কাঠামোটা হয়ে গেছে চুরির কাঠামো৷
৩. আমলা শ্রেণি৷ আমরা আগে এতটা সবল ছিল না৷ ৯০-এর পরে সিভিল আমলাদের ক্ষমতায়ন হয়েছে৷
৪. প্রফেশনাল রাজনীতিবিদ৷
তিনি বলেন, ‘‘প্রফেশনাল রাজনীতিবিদরাই হলেন একমাত্র গোষ্ঠী যারা সাধারণ মানুষের (পাবলিক) ওপর পুরোপুরি নির্ভর করেন৷ এখন সাধারণ মানুষের যেহেতু কোনো ভূমিকা রাজনীতিতে নেই, সেকারণে রাজনীতিবিদরা সবচেয়ে দুর্বল হয়ে গেছেন৷”
দু’টি বড় দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া নিয়েও বথা বলেন আফসান চৌধুরী৷ তিনি বলেন, ‘‘বিএনপিতে এখন আর রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়না৷ বিএনপি’র সেই সক্ষমতাও নেই৷ একজন জেলে৷ আরেকজন দেশের বাইরে৷ সেখান থেকে যা সিদ্ধান্ত আসে তাই দলের সিদ্ধান্ত৷”
আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আওয়ামী লীগ বা সরকারে রাজনৈকিভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷ সিদ্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা৷ আর শেখ হাসিনার প্রধান লোক এইচ টি ইমাম৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশে সিদ্ধান্ত নেন হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ৷ আর গত ৩০ বছরে বিশ্বে রাজনীতিতে পরিবর্তন এসেছে৷ জনগণ এখন রাজনীতিতে শুধু রাজনীতিদিদের দেখতে পায়না৷ তারা আরো অনেককে দেখতে পায়৷”
রাজনীতির এই পরিস্থিতি কি ইতিবাচক? যদি না হয় তাহলে এর পরিণতি কী হতে পারে? আর এই পরিস্থিতির কারণইবা কী? এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শামীম রেজা৷
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে নানা রাজনৈতিক উত্থান পতনের পরও যারা পেশাদার রাজনীতিবিদ তাদের প্রাধান্য রাজনীতিতে ছিল৷ তবে আম গত দুই-তিনটি সংসদের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখবো যারা দীর্ঘদিন রাজনীতিতে আছের তাদের জায়গায় অন্য পেশাজীবীরা চলে এসেছেন৷ আছেন আমলারা৷
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে অন্য রাষ্ট্রেতো প্রেসিডেন্টও হচ্ছেন ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকে৷ তারা আসলে একটি রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে হচ্ছেন৷ আমাদের এখানে ব্যবসায়ী বা আমলারা যখন সিদ্ধান্ত নেন তারা তাদের স্বার্থে নেন৷ জনগণের কথা ভাবেননা৷ যারা ভাববেন সেই প্রকৃত রাজনীতিবিদরা এখন গৌণ৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন ব্যবসা করে অল্প সময়ের মধ্যে রাজনীবিদ হওয়া, দীর্ঘদিন আমলা থেকে বা কোনো বাহিনীতিতে কাজ করে রাজনীতিতে অল্প সময়ে প্রভাবশালী হওয়া কোনো ভালো লক্ষণ না৷ রাজনীতিবিদরা যে রাজনীতি পরিচালনা করার কথা সেটা না থাকা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাশিত নয়৷ আমার মনে হয় এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে তা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য খারাপ খবর৷”
এসএইচ-০৮/০৫/১৯ (হারুন উর রশীদ স্বপন, তথ্য সূত্র : ডয়চে ভেলে)