প্রতিযোগিতায় টিকতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা কারখানায় যন্ত্রের ব্যবহার শুরু করেছেন৷ এ কারণে আগের তুলনায় শ্রমিক কম লাগছে৷ কর্মসংস্থান কমে যাওয়ার পেছনে এটি একটি কারণ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে৷
তৈরি পোশাক কারখানায় সবচেয়ে বেশি শ্রমিক প্রয়োজন হয় সুইং বা সেলাই পর্যায়ে৷ সেখানেই অটোমেশন বা যান্ত্রিকীকরণের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে বলে জানান শরীফ জহির৷
তিনি বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অন্যতম বৃহৎ রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক৷ নিজের কারখানার চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘‘যেখানে (জিন্সের প্যান্টের) একটা ব্যাক পকেট (তৈরির জন্য) চার জন অপারেটর দিয়ে কাজ করতে হতো, সেটা একটা যন্ত্র দিয়ে হয়ে যাচ্ছে৷ একজন অপারেটর দিয়েই হচ্ছে চারজনের কাজ৷”
তাঁর কারখানার প্রতিটি উৎপাদন লাইনে আগের চেয়ে প্রায় ২০ জন অপারেটর কম লাগছে, কমে যাচ্ছে সময়ও৷ এমন সুবিধার কারণে অনেক উদ্যোক্তাই এখন কারখানায় অটোমেশনের উপর জোর দিচ্ছেন৷
‘‘বড়-ছোট সবারই একটা রিয়েলাইজেশন এসেছে, যে ৪৫ থেকে ৫০ ভাগ অদক্ষতা নিয়ে আমরা চলছিলাম, সেটা দিয়ে আর সম্ভব না৷ যারা এটাকে উন্নত করতে পারবে, তারাই টিকবে৷ না হলে অনেক কারখানা অর্থ সঙ্কটে পড়ে যাবে৷ দক্ষতা বাড়ানোর জন্যই অটোমেশনে বিনিয়োগ করতে হবে,” বলেন শরীফ জহির৷
কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সফটওয়্যার অটোমেশন একটি সুইং যন্ত্র উদ্ভাবন করেছে, যার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাপড় কেটে তা প্রয়োজনমতো সেলাই করে জোড়া লাগানো যায়৷ এই যন্ত্র ব্যবহার করে এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে কারখানা খুলেছে চীনের প্রতিষ্ঠান তিয়ানইউয়ান গার্মেন্টস কোম্পানি৷
সেখানে প্রচলিত কারখানার চেয়েও ৫০ থেকে ৭০ ভাগ শ্রমিক কম লাগবে৷ কিন্তু উৎপাদন বাড়বে ৭০ ভাগ৷ চীনের কারখানাগুলোও ব্যাপকভাবে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির আওতায় আনা হচ্ছে৷ তাদের সাথে পাল্লা দিতে গত দুই-তিন বছর ধরে কারখানার যান্ত্রিকীকরণ শুরু করেছেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারাও৷
‘‘বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে প্রোডাক্ট ডেভেলাপমেন্ট এবং ম্যানুফেকচারিং প্রসেসে অটোমেশন শুরু হয়েছে৷ যেমন, থ্রিডি স্যাম্পলিং, অটোক্যাড, অটোকাটার এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি৷ হাইটেক সেন্সর মেশিন, বারকোড রিডার এসব ব্যবহার করা হচ্ছে৷ কিন্তু বিজনেস প্রসেসিংয়ে আমরা পিছিয়ে আছি৷ এই পার্টটা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে,” বলেন বাংলাদেশে দামি জিন্সের অন্যতম রপ্তানিকারক প্যাসিফিক জিন্সের পরিচালক সৈয়দ এম তানভীর৷
তৈরি পোশাক শিল্পের যান্ত্রিকীকরণ নিয়ে গত বছর জার্মানির দ্য ইন্সটিটিউট ফুর টেক্সটাইলটেকনিক অফ দ্য আরপিডাব্লিউএইচ আখেন ইউনিভার্সিটির সহযোগিতায় ম্যাককিনসি অ্যান্ড কোম্পানি একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে৷ তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কারখানার সুইং বা সেলাই পর্যায়ে, ৯০ ভাগ শ্রমিকের কাজই এখন যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব৷ একইভাবে ওয়্যারহাউজ, বন্ডিং, নিটিং, ফিনিশং প্রতিটি ধাপেই যন্ত্র ব্যবহার করে বিভিন্ন মাত্রায় শ্রমিক কমিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে৷ যান্ত্রিকীকরণ আর ‘লিড টাইম’ (পণ্য সরবরাহের সময়) কমানোর উপরই ফ্যাশন শিল্পের ভবিষ্যৎ ব্যবসা নির্ভর করছে বলেও এই প্রতিবেদনে উঠে আসে৷
বাংলাদেশের উদ্যোক্তারাও সেই একই চ্যালেঞ্জের কারণে যান্ত্রিকীকরণের দিকে ঝুঁকছেন বলে জানান তানভীর৷ নিজের প্রতিষ্ঠানের উদারহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের মেইন কম্পিটিটর তুরস্ক৷ তারা ইউরোপের খুব কাছে৷ লিড টাইমের দিক থেকে তারা অটোমেটিক জিওগ্রাফিক অ্যাডভান্টেজ পাচ্ছে৷ আমরা যখন অটোমেশনে যাই তখন কস্ট রিডাকশন কিংবা ম্যান পাওয়ার রিডাকশনের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ আমি কম্পিটিটিভ অ্যাডভান্টেজ ক্রিয়েট করতে পারছি কিনা৷”
রানা প্লাজা ধসের পর দেশের তৈরি পোশাক খাত নিয়ে শঙ্কা তৈরি হলেও তার প্রভাব তেমন একটা পড়েনি রপ্তানি আয়ে৷ ২০১৩ সাল থেকে এই খাতে বছরে গড়ে ১০ ভাগের মতো রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে৷ অথচ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে এই সময়ে গার্মেন্টস খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে গড়ে মাত্র ২ ভাগ করে৷ ২০১৩ সালের ৩০ লাখ থেকে শ্রমিক সংখ্যা বেড়ে ২০১৭ সালে শ্রমিক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৩ লাখে৷
আবার এই পাঁচ বছরে টেক্সটাইল বা বস্ত্রশিল্পে বাড়ার বদলে বরং ৪ লাখের বেশি কর্মসংস্থান কমে গেছে৷ ২০১৩ সালে যেখানে এই খাতে সাড়ে ১৮ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত ছিল, ২০১৭ সালে তা নেমে এসেছে ১৪ লাখে৷
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডির গবেষক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘উৎপাদনশীলতা বাড়ার কারণেই কম শ্রমিক দিয়ে বেশি উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে৷ প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার ফলে আগে যেসব শ্রমিক কারখানার সহজ কাজ যেগুলো করতেন সেই ধরণের কাজ কমে যাচ্ছে৷ সেগুলো এখন মেশিন দিয়েই করা সম্ভব হচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে৷”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস-এর হিসাবে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে গোটা ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ৯৫ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত ছিল, যা ২০১৭ সালে সাড়ে ৮৭ লাখে নেমে এসেছে৷ অর্থাৎ, এই সময়ে আট লাখ শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন এই খাত থেকে৷ বছরে কর্মসংস্থান কমে গেছে ১ দশমিক ৬ ভাগ হারে৷ অথচ ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের আয়ও গড়ে ১০ ভাগের বেশি বেড়েছে এই সময়ে৷
ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের কর্মসংস্থানের প্রায় ৬০ ভাগই আসে গামের্ন্টস ও টেক্সটাইল শিল্প থেকে৷ সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনোমিক মডেলিং-সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘‘বিদ্যমান প্রধান খাতটিতে কর্মসংস্থান কমে গেছে৷ কিন্তু এমন কোনো নতুন খাত তৈরি হয়নি যার মাধ্যমে এই ক্ষতিটা পুষিয়ে নিয়ে কর্মসংস্থান বাড়াতে পারি৷”
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের বাজারে কী ধরণের প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে সরকারি সংস্থা এটুআই ও আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলও একটি যৌথ গবেষণা করেছে৷ সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, যান্ত্রিকীকরণের কারণে, বাংলাদেশে ৫টি খাতে ৫৩ দশমিক ৮ লাখ কর্মসংস্থান ঝুঁকির মুখে রয়েছে৷ ২০৪১ সালের মধ্যে তৈরি পোশাক খাতেরই ২৭ লাখ বা বিদ্যমান ষাটভাগ কর্মসংস্থান হারিয়ে যেতে পারে৷ ফার্নিচার শিল্পের ১৩ দশমিক ৮ লাখ, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও পর্যটন খাতে ঝুঁকিতে আছে ৬ লাখ করে৷ ১ লাখ কর্মসংস্থান চলে যেতে পারে চামড়া শিল্প থেকেও৷
এসএইচ-০৫/০৮/১৯ (ফয়সাল শোভন, ডয়চে ভেলে)