রমজানের বাজার নিয়ন্ত্রণে আছে?

রোজা এলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ে৷ এবারও বেশ কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে৷ তবে সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে সার্বিকভাবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে দাবি করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী৷

সারা বছরের তুলনায় রোজায় চিনির চাহিদা তুলনামূলক বেশি থাকে৷ এই এক মাসে ৩ লাখ মেট্রিক টন চিনি লাগে, যার বিপরীতে আমদানি করা ছিল সাড়ে ১০ লাখ মেট্রিক টনের বেশি৷ ফেব্রুয়ারির পর বিশ্ববাজারে পণ্যটির দামও ছিল পড়তির দিকে৷ তারপরও টিসিবির হিসাবে রোজার আগের সপ্তাহে চিনির দাম এক মাস আগের তুলনায় সাড়ে নয়ভাগ বেড়ে যায়৷

একইভাবে মসুর ডাল, আদা, ছোলা রসুন অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে৷ কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সভাপতি গোলাম রহমানও বলেন, চিনি, পেঁয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম বেড়েছে৷ সার্বিকভাবে বাজার উর্দ্ধমুখী৷ তাঁর মতে, ‘‘সরকার যে হিসাব-নিকাশ করেছে তাতে চাহিদার চেয়ে রোজা সংশ্লিষ্ট যেসব পণ্য, সেগুলোর আমদানি মজুদ সবই ভালো ছিল৷ এর মানে সাধারণ নিয়মে দাম বাড়ার কথা নয়৷’’

বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে রোজার আগে প্রতিবারের মতো ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী৷ কিছু পণ্যের দাম বাড়লেও সার্বিকভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলেই মনে করেন তিনি৷ ‘‘আমরা প্রথম থেকেই বাজার মনিটরিংয়ের চেষ্টা করেছি যেন দাম না বাড়ে৷ সব বড় ব্যবসায়ীর সাথে কথা বলা হয়েছে৷ আগে থেকেই টিসিবিকে তৈরি রেখেছি, তারাও বাজারে যথেষ্ট পরিমাণ মালপত্র নিয়ে এসেছে৷ ব্যবসায়ীরাও কথা দিয়েছিল দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে৷ মোটামুটি যেটা আমাদের প্রত্যাশা ছিল, তার মধ্যেই আছে,’’ ডয়চে ভেলেকে বলেন টিপু মুনশি৷

সাধারণ নিয়মে জোগান বা সরবরাহের চেয়ে চাহিদা বেশি থাকলে পণ্যের দাম বাড়ে৷ কিন্তু পর্যাপ্ত মজুদ থাকা সত্ত্বেও কেন দাম বৃদ্ধি পায়? ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘‘দুটি কারণে দাম বেড়েছে বলে মনে হয়৷ একটা কারণ হলো, রোজার প্রথম দিকে অনেক ক্রেতা একসাথে বেশি জিনিস কেনে৷ তার ফলে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়৷ আর দ্বিতীয় কারণ হলো, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী রোজা উপলক্ষ্যে সব সময় দাম বাড়াতে চায়৷’’

বাণিজ্যমন্ত্রী মনে করেন, ব্যবসায়ীদের দাম বৃদ্ধির সুযোগ করে দেন ভোক্তারাই৷ তিনি বলেন, ‘‘এটা মানসিকভাবে একটা সমস্যা৷ ভোক্তারা রোজার শুরুতেই সারামাসের কেনাকাটা করে ফেলতে চান৷ তার জন্য একটুখানি চাপ পড়ে, সেটা এক দুইদিনের জন্য৷” তিনি মনে করেন, ১৫ রমজানের পর ব্যবসায়ীরা উদ্বৃত্তের কারণে মজুদ পণ্য বিক্রিই করতে পারবেন না৷ তখন কেনা দামের চেয়েও কম দামে তাদের পণ্য ছাড়তে হবে৷

তবে এবার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে অন্যবারের চেয়ে বেশি উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ রাজধানীতে প্রতিদিনই বাজার মনিটরিংয়ে নামছে সিটি কর্পোরেশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের দল৷ করা হচ্ছে জরিমানাও৷

ভোক্তা অধিকার আইন অনুযায়ী নির্ধারিত মূল্যে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করা হলে ১ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে৷ যারা কারসাজি করছে, তাদের বিরুদ্ধে এই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছেন বলে জানান সিটি কর্পোরেশনের হয়ে বাজার মনিটরিং করা আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা শামসুল হক৷ এক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না বলেও জানান তিনি৷ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শফিকুল ইসলাম লস্কর বলেন, ‘‘সাধারণত আমরা দিনে (ঢাকায়) দুটি বাজার মনিটরিং করি, এখন চারটি করছি দৈনিক৷ অন্য সময় সপ্তাহে ৫ দিন করা হয়, এখন শুক্র, শনিবারও করছি৷’’

ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন বাজারে ঘুরে দামে অসঙ্গতি পাওয়ায় জরিমানা করেছে৷ এমনকি নামিদামি সুপারশপগুলোকেও বড় অংকের জরিমানা করা হয়েছে৷ এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘শপিংমলগুলোতে ষাট টাকা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছিল, আমরা বাধ্য করেছি ৩০ টাকায় বিক্রি করতে৷’’

ভ্রাম্যমাণ আদালতের উপস্থিতি টের পেয়ে অনেক সময় খোলা বাজারগুলোতে ব্যবসায়ীরা দাম কমিয়ে দেয়, তাৎক্ষণিকভাবে মূল্য তালিকা ঝুলায়৷ এবার কিছুক্ষেত্রে ক্রেতা সেজেও পরিদর্শকরা আগে দাম জেনে নিচ্ছেন৷ পরে জরিমানা করছেন৷ এ ব্যাপারে শামসুল হক বলেন, ‘‘মোবাইল কোর্ট যখন করি, আমরা কাউকে জানিয়ে যাই না৷ আমি থানাকেও বলি না যে, আমি ওখানে মোবাইল কোর্টে যাবো৷ আমাদের যে জরিমানাগুলো হচ্ছে, তাতেই বোঝা যাচ্ছে যে তারা টের পায় না৷ মোবাইল কোর্টটা নিয়ে আমরা অতর্কিতেই যাই, হঠাৎ করে একটা অভিযান চালাই৷’’ প্রথম দুই দিনে তিনি ছয় জন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছেন বলে জানান৷

যদিও সারা দেশের ব্যাপ্তির তুলনায় বাজার মনিটরিংয়ের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে৷ ঢাকায় প্রায় ২০০টি বাজার পর্যবেক্ষণে সব মিলিয়ে সরকারের আটটি টিম কাজ করছে৷ ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরে ঢাকার বাইরে জেলা পর্যায়ে একজন মাত্র কর্মকর্তা দিয়ে বাজারে নজরদারি করছে৷ তার মধ্যে ১৫-১৬ টি জেলায় তাদের কোনো অফিসই নেই৷ উপজেলা পর্যায়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যক্রমই নেই৷

সীমাবদ্ধতা থাকলেও রোজায় বাজার নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে সরকার কঠোর অবস্থান নিয়েছে বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী৷ বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে সব বিভাগীয় কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে৷ পুলিশের ডিআইজিকে চিঠি দেয়া হয়েছে, তাঁরাও যেন সতর্ক থাকে, রাস্তাঘাটে যাতে কোনো চাঁদাবাজি না হয়, নিয়মিত যাতে বাজার মনিটরিং করা হয়৷ প্রথম তিন দিনে সারা দেশে কমপক্ষে ৫০ টি জায়গায় ব্যবসায়ীদের জেল, জরিমানা করা হয়েছে বলে জানান তিনি৷ বলেন, ‘‘আমরা শক্ত অবস্থানে আছি৷ রমজানে ভোক্তাদের যাতে কষ্ট না হয়, সে ব্যাপারে আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করছি৷’’

সরকারের এই অবস্থানের কিছুটা সুফল মিলেছে বলে মনে করেন গোলাম রহমান৷ তিনি বলেন, ‘‘যদি কার্যক্রম একেবারে না থাকত, তাহলে ভেজাল, নকল ও দাম বৃদ্ধি আরো ব্যাপকতর হতো৷ সরকারের মনিটরিং ও তত্ত্বাবধানের কারণে এটা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণে আছে৷ তবে কার্যক্রমটা জোরদার করা দরকার, যাতে ভোক্তারা অসাধু ব্যবসায়ীদের হয়রানির শিকার না হয়৷’’

এসএইচ-০৫/১২/১৯ (ফয়সাল শোভন, তথ্য সূত্র : ডয়চে ভেলে)