বিটিআরসি, গ্রামীণ ও রবির বিরোধে গ্রাহকরা বিপাকে

গত ৫ই জুলাই রবির একটি এসএমএস পান বহু গ্রাহক। এতে বলা হয়, “বিটিআরসি ব্যান্ডউইথ কমাতে সরবরাহকারীদের নির্দেশ দিয়েছে। এতে আমাদের ইন্টারনেট সেবা কিছুটা বিঘ্নিত হতে পারে। এজন্য আমরা দু:খিত। সমস্যাটির দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে”।

পরে সাতই জুলাই গ্রামীণ ফোনও তাদের গ্রাহকদের একটি বার্তা পাঠায়। ভাষাগত ভিন্নতা থাকলেও একই তথ্যই মূলত তারা গ্রাহকদের জানায়। তাদের বার্তায় বলা হয়, “গ্রামীণফোনের ব্যান্ডউইথ কমাতে সরবরাহকারীদের নির্দেশ দিয়েছে বিটিআরসি। এতে ইন্টারনেট সেবা কিছুটা বিঘ্নিত হতে পারে। এ সমস্যার জন্য আমরা দু:খিত। সিদ্ধান্তটি বিবেচনা করতে বিটিআরসি-কে অনুরোধ করেছি”।

আবার বিটিআরসির দিক থেকে বলা হচ্ছে, “বর্তমান টেলিযোগাযোগ আইনে সালিশের মাধ্যমে বিষয়টি নিষ্পত্তির সুযোগ নেই। সেবা ব্যবহারকারী গ্রাহকদের অসুবিধার জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দু:খিত। কমিশন আশা করছে, শীঘ্রই এ পাওনা পরিশোধ করে অপারেটর দুটি স্বাভাবিক গতিতে গ্রাহকদের সেবা প্রদানে সচেষ্ট হবে”।

অর্থাৎ গ্রামীনফোন, রবি এবং বিটিআরসি তিন পক্ষই গ্রাহকদের অসুবিধার বিষয়টি স্বীকার করে দু:খ প্রকাশ করছে। কারণ ব্যান্ডউইথ কমানোর ফলে দুটি কোম্পানির গ্রাহকরাই ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে।

তাহলে গ্রাহকদের ক্ষতি বন্ধ করতে কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করছেনা কেনো বিটিআরসি? জবাবে সংস্থার সিনিয়র সহকারী পরিচালক জাকির হোসেন খান বলেন, “কোনো গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি যদি আমাদের জানান (১০০ নাম্বারে কলে অভিযোগ করা যায়) তাহলে আমরা অবশ্যই দেখবো যে এটি কি ব্যান্ডউইথের কারণে নাকি অপারেটরের অন্য কোনো কারণে এটা হচ্ছে। আমাদের গ্রাহক স্বার্থও নিশ্চিত করতে হবে পাশাপাশি দেখতে হবে অপারেটররাও সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে”।

আবার বিটিআরসির সাথে কোম্পানির দ্বন্দ্বের জের ধরে গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হবে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে গ্রামীণফোনের পক্ষ থেকে এর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ( এক্সটার্নাল কমিউনিক্যাশন্স) মুহাম্মদ হাসান বলেন, “আমরা মনে করি বিটিআরসির ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ কমানোর স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত অনুচিত এবং বেআইনি, তা যে মাত্রাই কমানো হোক না কেন। একটি অসম্পর্কিত ও বিতর্কিত দাবীর ভিত্তিতে গ্রাহকদের ক্ষতি করার বিটিআরসির এই কার্যক্রমকে যেকোনো যুক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিই প্রশ্ন করবে। গ্রামীণফোন একটি গঠনমূলক সালিশ প্রক্রিয়ার প্রস্তাব করেছে। বিরোধের দ্রুত নিষ্পত্তির স্বার্থে আমরা বিটিআরসিকে অনুরোধ করবো আমাদের প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিতে”।

তাহলে কি বিটিআরসি তাদের প্রস্তাবে সাড়া না দিলে গ্রামীণফোনের গ্রাহকরা ইন্টারনেট সেবার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হতেই থাকবে? এমন প্রশ্নের কোনো জবাব মেলেনি প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে।

অন্যদিকে টেলিকম কোম্পানি রবি বলছে তারা মনে করে ব্যান্ডউইথের ঘাটতি হলে টেলিযোগাযোগ সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক।

তবে তারা ইন্টারনেটের স্পীড বা গতির দায়িত্ব তাদের নয় বলেই বিবিসি বাংলাকে বলছেন তারা।

রবি আজিয়াটা লিমিটেডের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “আমাদের সাথে যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো বিষয়ে বিরোধ থাকে সে জন্য গ্রাহক সেবা বিঘ্নিত হওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত। আমাদের ব্যান্ডউইথ কমানোর সিদ্ধান্তটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা আন্তর্জাতিক ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছে, সুতরাং নিয়ন্ত্রক সংস্থাই এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারবেন। আমরা সীমিত ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে গ্রাহককে সর্বোচ্চ মানের সেবা দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আর গ্রাহক আমাদের কাছে যে পরিমাণ ইন্টারনেট ডেটা কিনছেন ঠিক সে পরিমাণই ব্যবহার করছেন; আমরা গ্রাহকদের কাছে গতি বিক্রি করি না”।

বিটিআরসির হিসেব অনুযায়ী দেশে মোবাইল ফোন গ্রাহকের সংখ্যা ১৬ কোটির বেশি। এর মধ্যে গ্রামীণের ৭ কোটি ৪৮ লাখ আর রবির ৪ কোটি ৭৭ লাখ গ্রাহক আছে।

গ্রামীণফোনের ৩০ শতাংশ ব্যান্ডউইথ আর রবির ১৫ শতাংশ ব্যান্ডউইথ কমানোর জন্য আইআইজি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে বিটিআরসির তরফ থেকে।

গত ৪ঠা জুলাই রবির ও ৭ই জুলাই গ্রামীণফোনের ব্যান্ডউইথ সীমিত করতে আইআইজি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশ দেয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।

এর আগে বকেয়া হিসাবে গ্রামীণফোনকে ১২ হাজার ৫৭৯ কোটি ৯৫ লাখ টাকা আর রবিকে ৮৬৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা পরিশোধ করার নির্দেশ দিয়েছিল বিটিআরসি। তবে এ পাওনার বিষয়ে শুরু থেকেই দ্বিমত পোষণ করে আসছে গ্রামীণ ও রবি।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে বলেছেন কোম্পানি দুটিকে অবিলম্বে পাওনা পরিশোধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

তিনি বলেছেন, “মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে গ্রামীণফোন ও রবির অডিট হয়েছে। অন্যদেরও অডিট হবে। পাওনা আদায় করার জন্য কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে”।

সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন যে পদ্ধতিতে কোম্পানি দুটি সরকারকে এতদিন যে রাজস্ব দিয়েছে তার বাইরে কিছু ক্ষেত্রে কর ফাঁকির ঘটনা ঘটেছে।

তবে এর আগে রোববারই সংবাদ সম্মেলন করে বিটিআরসির সিদ্ধান্তকে বেআইনি আখ্যায়িত করে এবং এর বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথা জানায় তারা।

নির্দেশনাটি তুলে নিয়ে সালিশ আইন ২০০১ এর আওতায় অমীমাংসিত অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির প্রস্তাব দেয় তারা।

যদিও সংসদে মন্ত্রী বলেছেন বিদ্যমান সালিশ আইন অনুযায়ী বিষয়টি নিষ্পত্তি সম্ভব হবেনা।

বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি প্রতিষ্ঠান দুটির কর্মকর্তারা।

তবে জানা গেছে গ্রামীণফোন এবং রবি অডিট শুরু থেকে এর প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে।

তবে তারা যেটি বলার চেষ্টা করেছেন তা হলো টেলিযোগাযোগ আইন অনুযায়ী প্রতি বছর অডিট করার কথা থাকলেও বিটিআরসি সেটি করেনি।

২০১১ সালে জিপি অডিট করে ৩০৩৪ কোটি টাকা দাবি করে বিটিআরসি।

পরে জিপি পাওনা অস্বীকার করে এবং অডিট প্রত্যাখান করে আদালতে যায়।

পরবর্তীতে আদালত তুনভাবে অডিট করার নির্দেশনা দেয়।

২০১৭ সালে নতুন ভাবে অডিট শুরু করে গ্রামীণফোনের কাছে ১২৫৭৯ কোটি টাকা পাওনা দাবি করে।

এর মধ্যে প্রায় ৬১৯৪ কোটি মুল টাকার উপর সুদ ধরা হয়েছে।

বাকি পাওনার মধ্যে ৪০৮৬ কোটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পাওনা যেটাও জুড়ে দেয়া হয়েছে।

বিটিআরসি এবং গ্রামীণ ও রবির মধ্যকার বিরোধে শাস্তি পাচ্ছে কে?

তিন পক্ষই স্বীকার করছে যে আসলে গ্রাহকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ঢাকার বেসরকারি চাকুরজীবি নুসরাত জাহান রবির সিম ব্যবহার করেন।

তার অভিযোগ , ” সহজে ওয়েবপেজে ঢোকা যায়না। আবার কিছুক্ষণ চেষ্টা করলে দেখা যায় পেজ ওপেন হয়না কিন্তু ডেটা চলে যাচ্ছে। এভাবে তো চলতে পারেনা। আবার রিনি উেয়েবল ডেটা প্যাকেজ নেই। ফলে মেয়াদ শেষে অব্যবহৃত ডেটা থাকছেনা”।

আর ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী ফারিয়া রওশান গ্রামীণফোনের গ্রাহক।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছেন, “ব্যান্ডউইথ কমানোর পর প্রায়ই নেট স্লো পান তিনি, আর কলড্রপ সমস্যা তো আছেই “।

যদিও বিটিআরসি বলছে গ্রাহকরা যে ব্যান্ডউইথ কমিয়ে দেয়ার কারণেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কি-না সেটি অভিযোগ পেলে তারা অনুসন্ধান করবে।

আর গ্রামীণ ও রবি বলছে ব্যান্ডউইথ কমানোর কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

তবে প্রতিষ্ঠানটি তিনটি যাই বলুন বকেয়া পাওনা আদায়ে বিটিআরসিও এমন পদক্ষেপ নিয়েছে ফলে ইন্টারনেট সেবা ঠিকমতো পাচ্ছেনা গ্রাহকরা।

আবার বিটিআরসির সিদ্ধান্তকে বেআইনি বলেও গ্রাহকদেরই ক্ষতির বিষয়টি সামনে আনছে গ্রামীণ ও রবি।

অর্থাৎ তারাও বিটিআরসির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গ্রাহককেই ব্যবহার করছে।

ফলে তিন দিক থেকেই আসলে ক্ষতির শিকার হচ্ছে শুধুমাত্র- গ্রাহক।

কিন্তু গ্রাহকের অপরাধ কি—তার সুনির্দিষ্ট কোনো জবাব মেলেনি তিনটি প্রতিষ্ঠানের কোনোটির কাছ থেকেই।

বিটিআরসির সিনিয়র সহকারী পরিচালক জাকির হোসেন খান বলছেন, “গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সাময়িক অসুবিধার জন্য আমরা দু:খ প্রকাশ করছি”।

টেলিযোগাযোগ খাতে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছেন টিআইএম নূরুল কবীর। মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর সংগঠন অ্যামটবের সাবেক মহাসচিব তিনি।

তিনি বলছেন, “এটি অন্যায্য। অগ্রহনযোগ্য”।

তিনি বলেন আঠার বছর ধরে অডিট কেনো করেনি বিটিআরসি। এখন পুরনো অডিটের জন্য কোম্পানিগুলোর সাথে বিরোধের জের ধরে তারা এমন কিছু করবে কেনো যাতে ইন্টারনেট সেবায় সমস্যায় পড়ে গ্রাহক।

এসএইচ-০৫/১১/১৯ (রাকিব হাসনাত, বিবিসি)