জন্মনিয়ন্ত্রনে পুরুষদের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে

দেশে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব পদ্ধতি রয়েছে তার মধ্যে মাত্র ৭ শতাংশ রয়েছে কনডমের ব্যবহার। দেশে যত ধরনের পদ্ধতি রয়েছে তার দুটি ছাড়া সবই নারীদের জন্য। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারি প্রচার প্রচারণাতেও নারীদেরই টার্গেট করা হচ্ছে।

কিন্তু জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে দায়ভার কি শুধু নারীর? জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুরুষদের কতটা উৎসাহিত করা হচ্ছে?

পুরুষরা কী বলছেন? জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন কিনা বা কোন পদ্ধতি ব্যবহার করেন?

নাম ও পরিচয় প্রকাশ করতে চাইলেন না বেশিরভাগ পুরুষ। বনানী এলাকায় একজন গাড়ি চালকের সাথে কথা হচ্ছিলো।

তিনি বলছেন, “আমার ওয়াইফ তো ই খায়, কি যেনও বলে, বড়ি খায়। আর আমার কোন পদ্ধতি নাই। আমি কোন পদ্ধতি নেই নাই। আমার ওয়াইফই ব্যবহার করে।”

আরও কয়েকজনের সাথে কথা হচ্ছিলো। যাদের বেশিরভাগই বললেন জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি ব্যবহারের মুল দায়িত্ব নারীদেরই।

ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দিতে সকলেই কিছুটা সংকোচ বোধ করছিলেন। মুখের ভাব বা কণ্ঠ শুনে সেটি বোঝা যাচ্ছিলো। কেন নারীদের দায়িত্ব বেশি তার পরিষ্কার ব্যাখ্যাও তারা দিতে পারলেন না।

কিন্তু যে গুরুদায়িত্ব নারীরা পালন করছেন সে সম্পর্কে কথা বলছিলেন কিছুদিন আগে কপার টি ব্যবহার শুরু করেছেন এমন একজন।

তিনি বলছেন, “এটা পরার সময় কষ্ট হয়। পরার পরে প্রতি পরিয়ডের সময় পেটে ব্যথা হয়। খুব বেশিই হয়। সেটা কমাতে আমার পেইন কিলার খেতে হয়। আগে ব্যথা এতটা ছিল না। আরেকটা হল পিরিয়ড চলাকালীন ব্লিডিংটা বেশি হয়।”

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই নারীও। তিনি বলছেন, স্বামীর কনডম ব্যাবহারে অনিচ্ছার কারণেই তাকে কপার টি নিতে হয়েছে।

“বেশিরভাগ সময় কনডম পরতে চায় না বলেই আমার এই অবস্থা। কিছু সময় আছে ব্যবহার করতে একটুও চাইবে না। কিছু সময় আমার কথা শুনে পরতে বাধ্য হয়।”

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ২০১৮ সালের হিসেবে দেশে সক্ষম দম্পতিদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করেন। প্রজননের হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর তুলনায় এগিয়ে রয়েছে।

কিন্তু দেশে পাওয়া যায় যেসব পদ্ধতি তার দুটি ছাড়া সবই নারীদের জন্য। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ড. আশরাফুন্নেসা বলছেন পুরুষদেরও এর দায়িত্ব নিতে হবে।

তিনি বলছেন, “পরিবারে পুরুষ প্রধানকেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করা উচিৎ। কারণ একজন নারী বাচ্চা বহন করে, বাচ্চা লালন পালন করে, ব্রেষ্ট ফিডিং করে। সে কিন্তু এসব ভূমিকা ইতিমধ্যেই পালন করছে। এখন জন্ম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যদি পুরুষরা এগিয়ে আসে তাহলে আমার মনে হয় নারী আরও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে এবং কর্মক্ষেত্রেও নারীর অংশগ্রহণ বেড়ে যাবে।”

তিনি নিজেই বলছেন, “পুরুষের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার কম। আমরা এখন জোর দিচ্ছি শুধু নারী নয়, নারীর পাশাপাশি পুরুষকেও জন্মনিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে হবে।”

যেসব পদ্ধতি এখন ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলো হল খাবার বড়ি, কপার টি, ইনজেকশন, লাইগেশন, চামড়ার নিচে বসিয়ে দেয়া জন্মনিয়ন্ত্রণ ক্যাপসুল, কনডম ও ভ্যাসেকটমি।

খাবার বড়ির ব্যবহার সবগুলো পদ্ধতির মধ্যে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ। ইনজেকশন ১১ শতাংশ।

সেই হিসেবে পুরুষদের জন্য যে দুটো পদ্ধতি তার মধ্যে কনডমের ব্যবহার মাত্র ৭ শতাংশ। পুরুষদের ভ্যাসেকটমির করার হার মোটে ১ শতাংশ। এসব হারই বলে দেয়া পরিবার পরিকল্পনায় পুরুষদের অংশগ্রহণ কতটা।

যেসব পদ্ধতি নারীদের জন্য রয়েছে তার অনেকগুলোরই রয়েছে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরই তার প্রচারণায় এসব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তথ্য দিয়ে থাকে।

যেমন কপার টি ব্যবহার করলে তলপেটে ব্যথা হতে পারে, নিয়মিত ফোটা ফোট রক্তস্রাব হতে পারে।

অনেক সময় প্রদাহ হতে পারে। চামড়ার নিচে বসিয়ে দেয়া জন্মনিয়ন্ত্রণ ক্যাপসুলে মাসিক অনিয়মিত অথবা উল্টো আবার রক্তস্রাব বেশি হতে পারে।

মাথা ব্যথা হতে পারে। ওজন বেড়ে যেতে পারে। ইনজেকশনেও একই ধরনের সমস্যা হয়।

খাবার বড়ি হরমোনে প্রভাব ফেলে। মাসিকের পরিমাণ কমে যায়। যোনিপথ শুষ্ক হয়ে যায়।

এসব অসুবিধা সহ্য করেই নারীদের জন্ম নিয়ন্ত্রণের দায়ভার বহন করতে হয়।

জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রচারণার সময় অসুবিধাগুলো কমই জানানো হয়। বরং সুবিধাগুলোর প্রচারণাই বেশি।

বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন উবিনিগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আক্তার।

তিনি বলছেন, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালা দুটোতেই নারীকে এই দায়ভার দিয়ে দিচ্ছে।

ফরিদা আক্তার বলছেন, “আপনি যদি জন্ম নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলো দেখেন কনডম এবং মেল স্টেরিলাইজেশন ছাড়া বাকি বড়ি থেকে শুরু করে, আইইউডি, ইনজেকটেবল ইমপ্ল্যান্ট সব কিন্তু মহিলাদের শরীরে করা হচ্ছে। পুরুষ যদি সন্তান চায় নারীকে দিতেই হবে। আবার সরকার বা রাষ্ট্র যখন ঠিক করে যে সন্তান বেশি নেয়া যাবে না সেটাও নারীর শরীরেই একটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে বন্ধ করা হয়।”

তিনি আরও বলছেন, “নারীর শরীরেই সন্তান হয়, ফলে নারীর শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এই দিক থেকে চিন্তা করে যেহেতু কন্ট্রাসেপটিভ তৈরি হচ্ছে সেজন্যে এটি নারীর শরীর কেন্দ্রিক হয়ে গেছে।”

তার মতে, “পুরুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে নারীকে শুধু সন্তান জন্মদানের মেশিন হিসেবে ভাবলে চলবে না। সন্তান ধারণে নারী ও পুরুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সমতা নিশ্চিত করতে হবে। সেটি যদি হয় তাহলে পুরুষ অবশ্যই নিজ দায়িত্বে পদ্ধতি গ্রহণ করবেন।”

তিনি বলছেন, নারীকেই সে ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে হবে এমন চিন্তা থেকে সরে আসতে হবে।

এসএইচ-০৪/১২/১৯ (শাহনাজ পারভীন, বিবিসি)