সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী কমছে!

দেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী যে কমেছে সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ আদমশুমারিই সেটা প্রমাণ করে৷ কত কমেছে সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে৷ এখন প্রশ্ন হচ্ছে তারা সংখ্যায় কেন কমেছে৷

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আদমশুমারি হয় ১৯৭৪ সালে তখন মোট জনসংখ্যার ১৩.৫ ছিলো হিন্দু৷ এপর ১৯৮১ সালের ১২.১ ভাগ, ১৯৯১ সালে ১০.৫, ২০০১ সালে ৯.৩ এবং ২০১১ সালে সর্বশেষ আদমশুমারিতে ৮.৫ ভাগ হিন্দু জনগোষ্ঠীর কথা বলা হয় ৷ আর এতে স্পষ্ট যে স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে কমেছে৷ আর এই সময়ে মুসলিম জনগোষ্ঠী বেড়েছে৷ ১৯৭৪ সালে শতকরা ৮৫.৪ ভাগ থেকে ২০১১ সালে ৯০.৪ ভাগে উন্নীত হয়েছে৷ তবে এই সময়কালে বৌদ্ধ ০.৬ ও খ্রিস্টান ০.৩ ভাগ ছিলো৷ অন্যন্য ধর্মাবলম্বী ০.২ থেকে ০.৩ ভাগ এর মধ্যে৷ এই হিসাবটি সরাসরি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর(বিবিএস) হিসেব থেকেই তুলে ধরা হয়েছে৷এই হিসেবে দেখা যায় বাংলাদেশে বৌদ্ধ , খ্রিস্টান এবং অন্য ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা কমেনি, একই আছে৷

১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১৪ লাখ ৭৮ হাজার ৷ তখন মোট মুসলমানের সংখ্যা ছিলো ৬ কোটি ১০ লাখ ৩৯ হাজার৷ আর হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিলো ৯৬ লাখ ৭৩ হাজার৷ ২০১১ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১৪ কোটি ৪০ লাখ ৪৪ হাজার৷ আর হিন্দুদের সংখ্যা হয় ১ কোটি ২৩ লাখ৷ এই সময়কালে মোট জনসংখ্যার আনুপাতিক বা শতকরা হারে মুসলিম জনগোষ্ঠী বাড়লেও হিন্দু জনগোষ্ঠী আনুপাতিক হারে না বেড়ে উল্টো কমেছে৷ আর সেটা শতকরা হিসেবে পাঁচ ভাগ৷

বাংলাদেশে সবশেষ আদমশুমারি হয়েছে ২০১১ সালে৷ প্রতি ১০ বছর পর পর আদমশুমারি হয়৷ সেই হিসেবে ২০২১ সালে ষষ্ঠ আদমশুমারি হওয়ার কথা৷

তবে আদমশুমারি ছাড়াও প্রতিবছর পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের অধীনে বিবিএস বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রকাশ করে৷ তাতে ২০১৮ সালের প্রদিবেদনে বলা হয় বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী মোট জনসংখ্যার ৮৮.৪ ভাগ৷ হিন্দু এবং অন্য ধর্মাবলম্বী ১১.৬ ভাগ৷ এখানে হিন্দুদের শতকরা হার আলাদাভাবে দেওয়া হয়নি৷ এই হিসেবে দেখা যায় ২০১১ সালের পর শতকরা হিসেবে মুসলিম জনগোষ্ঠী কিছুটা কমেছে৷ হিন্দুসহ অন্যান্য ধর্মবলম্বী জনগোষ্ঠী শতকরা হিসেবে কিছুটা বেড়েছে৷ বৌদ্ধ ও খিস্ট্রান ধর্মের অনুসারি একই থাকায় হিসেব করে বলা যায় হিন্দু এখন মোট জনগোষ্ঠীর ১০.৫৯ ভাগ৷ মোট জনসংখ্যা বলা হয় ১৬ কোটি ৪৬ লাখ৷ সেই হিসেবে বাংলাদেশে হিন্দু জনগোষ্ঠী এখন ১ কোটি ৭৪ লাখ৷ এই হিসেব ধরলে ২০১১ সাল ধেকে ৮ বছরে দেশে হিন্দু জনগোষ্ঠী বেড়েছে ৫১ লাখ৷ তবে এই ৫১ লাখ কিভাবে বাড়ল তার কোনো ব্যাখ্যা নেই৷ আর এই সময়ে কোনো আদমশুমারিও হয়নি৷

বিবিএস-এর ২০১৫ সালের একই প্রতিবেদনে মোট জনসংখ্যার ১০.৭ শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী বলে উল্লেখ করা হয়৷ আগের বছর ৯ .৯ শতাংশ৷

২০১১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ে ১৯১১ সাল থেকে তথ্য দেয়া হয়৷ তাতে দেখা যায় এই অঞ্চলে ১৯১১ সালে মোট জনগোষ্ঠীর ৬৭.২ ভাগ ছিলো মুসলিম৷ হিন্দু ৩১ ভাগ৷ ১৯২১ সালে৬৮.১ ভাগ মুসলিম , হিন্দু ৩০.৬৷ ১৯৩১ সালে মুসলিম ৬৮.৫, হিন্দু ১৯.৪ ভাগ, ১৯৪১ সালে মুসলিম ৭০.৩, হিন্দু ২৮৷ ১৯৫১ সালে মুসলিম ৭৬.৯, হিন্দু ২২৷ ১৯৬১ সালে মুসলিম ৮০.৪, হিন্দু ১৮.৫৷ ১৯৭৪ সালে মুসলিম ৮৫.৪, হিন্দু ১৩.৫ ভাগ৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং গবেষক ড. আবুল বারকাত তার ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ নামের গবেষণা গ্রন্থে বলেছেন ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল সময়কালে আনুমানিক ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন৷

তিনি বলেন,‘ এই গবেষণার বাইরে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ আছে৷ ১৯৪১ সালের আদমশুমারীতে মোট জনসংখ্যার ২৯.৭ ভাগ ছিলো হিন্দু৷ এখনো ২৯.৭ ভাগ হিন্দু থাকার কথা৷ এখন যা জনসংখ্যা তাতে কম বেশি ৫ কোটি হিন্দু থাকার কথা৷ কিন্তু আছে ১ কোটি ৪০-৫০ লাখ৷ এই দু’টি বিয়োগ করলেই ৩ কোটি ৭০ লাখ হয়৷ প্রিয়া সাহা সেটাই হয়তো বলেছেন৷ কিন্তু এভাবে সরল হিসাব করা যায় না৷ এখানে পদ্ধতিগত ভুল আছে৷ কারণ ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হয়েছে৷ তখন পলিটিক্যাল মাইগ্রেশন হয়েছে৷’

তিনি বলেন,‘ যেসব হিন্দু নিরুদ্দিষ্ট হয়েছেন তারা দেশ ছেড়েছেন৷ আর কমনসেন্সেই বলা যায় তারা ভারতে গেছেন৷ গরীব হিন্দুরাতো আর জার্মানি অ্যামেরিকা যেতে পারেনি৷’

তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের এই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার ছয়টি কারণ চিহ্নিত করেন৷

১. এই অঞ্চলে মুসলমানদের ফার্টেইলিটি রেট বেশি

২. ৬৪ সালের দাঙ্গা

৩. ৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ

৪. এনিমি প্রোপার্টি এ্যাক্ট

৫. ভেস্টেড প্রোপার্টি এ্যাক্ট এবং

৬. নিরপত্তাহীনতা৷

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ যোগ করেন সংবিধানে রষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের অন্তর্র্ভূক্তিকে৷ তিনি বলেন,‘‘হিন্দুদের ওপর আক্রমনের মূল টার্গেট হলো তাদের জমি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল৷ এটা যাদের ক্ষমতা আছে তারাই করে৷ এই টার্গেটে ক্ষমতাহীন মুসলমানরাও আছেন৷”

প্রসঙ্গত, সিলেট বিভাগে হিন্দু জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি৷ আর সবচেয়ে কম রাজশাহীতে৷ মুসলিম সবচেয়ে বেশি ময়মনসিংহে এবং সবচেয়ে কম সিলেটে৷

এসএইচ-০৫/২৪/১৯ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)