২০ লাখ মানুষের যাওয়ার জায়গা নেই

দেশের অধিকাংশ নাগরিক মুসলিম৷ ফলে মুসলিমদের প্রধান দুই ধর্মীয় উৎসব- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় স্পষ্ট হয় রাজধানী ঢাকার চরিত্র৷ প্রায় দুইকোটি মানুষের এই শহর তখন ফাঁকা হয়ে যায়৷ কিন্তু এর মধ্যেও রয়েছে একটা কিন্তু৷

ঢাকার জনসংখ্যা এখন বলা হয়ে থাকে এক কোটি ৭০ লাখ৷ এর প্রায় অর্ধেক মানুষ ঈদের সময় ঢাকা ছেড়ে গ্রামে বা ঢাকার বাইরে চলে যান৷ সারাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের পরও ঢাকার বাইরে যাওয়া জনস্রোত কোনোভাবেই কম নয়৷ পথের দুর্ভোগ উপেক্ষা করেও বরাবরের মতোই মানুষ গ্রামে ছুটেছেন৷

নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘‘এখানে চাকরি, নানা ধরনের কাজ ও ব্যবসার কারণে মানুষ বসবাস করে৷ যাদের অধিকাংশই আসলে ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন৷ ফলে তাদের বাড়ি বলতে যা বোঝায় তা তাদের গ্রামের বাড়ি৷ সেখানেই তাদের বাবা-মা আত্মীয় স্বজন থাকেন৷ তাই তারা উৎসব পার্বনে গ্রামেই ছুটে যান৷ তিনি বলেন, ‘‘ঢাকা শহরে যারা বসবাস করেন তাদের পরিবারে প্রধানদের শতকরা ৬০ ভাগ গ্রামে জন্ম নিয়েছেন৷ তারা ওই গ্রামকেই তাদের আসল ঠিকানা বলে মনে করেন৷ আর ঢাকায় যারা বসবাস করেন তাদের অনেকেরই এখানে বাড়ি-ঘর নেই৷ তারা ভাড়া থাকেন৷ ”

তিনি বলেন, ‘‘ঢাকা আর গ্রাম মিলিয়ে একটি জনগোষ্ঠী আছে৷ যাদের দুই জায়গায়ই ঘরবাড়ি আছে৷ তাদের সংখ্যা কম৷ কিন্তু আরেকটি গ্রুপ আছেন, যাদের আসলে স্থায়ী কোনো বাড়ি-ঘর নাই৷ তারা গ্রাম থেকে এসেছেন৷ নদী ভাঙনের শিকার অথবা দারিদ্র্যের কারণে সব কিছু হারিয়ে এখন ঢাকায় এসে বস্তিতে থাকেন৷ তারা আসলে ঈদে ঢাকা ছেড়ে কোথাও যান না৷ কারণ তাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই৷ আর উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত যারা অনেক বছর ধরে ঢাকায় আছেন৷ আত্মীয়-স্বজন এখানে আছেন, বাড়ি-ঘর আছে৷ তারাও সাধারণত ঢাকা ছড়েন না৷”

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক ও নগর পরিকল্পনা বিশেষজ্ঞ ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘‘আমরা নানাভাবে দেখেছি ঢাকা শহরে ভবনের মালিকানা আছে এরকম মানুষের সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ ভাগের মত৷ কোনো পরিসংখ্যানই শতকরা ২০ ভাগের বেশি যায় না৷ বাকিরা এখানে ভাড়া থাকেন৷”

তিনি জানান, ‘‘সরকারি হিসেবে ১১ লাখ হলেও বাস্তবে ঢাকায় এখন ৫০ লাখ লোক বস্তিতে থাকেন৷ তাদের মধ্যে কমপক্ষে ২০ লাখের আসলে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই৷ তারা বাস্তুচ্যুত হয়ে এই শহরে বসবাস করছেন৷ আর বস্তির প্যাটার্ন পরিবর্তন হওয়ায় এটা নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি আছে৷ এখন প্রচুর টিনশেড বা সেমিপাকা বস্তিও আছে৷”

এইসব পরিসংখ্যান বিচেনায় নিলে ঢাকায় বাড়ির মালিকানা নিয়ে স্থায়ী বাসিন্দা অছেন কম৷ এই সংখ্যা কোনোভবেই ৩৫-৪০ লাখের বেশি হবে না৷ ফলে উৎসবের সময় ঢাকায় বসবাসকারীদের বড় একটি অংশ গ্রামে বা অন্য শহরে চলে যায়৷ তারা বাবা-মায়ের কাছে যায়৷ স্বজনদের কাছে যায়। শুধু বাড়ি-ঘর নয় তাদের সহায় সম্পত্তিও গ্রামে৷ তারা শহরে থাকলেও অর্থনৈতিকভাবেও অনেকে গ্রামের ওপর কম-বেশি নির্ভরশীল৷ কারণ গ্রামে তাদের কারুর কৃষি জমি আছে বা অন্য কোনো আয়ের উৎস আছে৷

আবার অনেকে শহরেও থাকলে সহায় সম্পত্তি বা বিনিয়োগ করেন গ্রামে বা নিজ এলাকায়৷

তাহলে ঢাকা শহরের চরিত্রটি কেমন? অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মনে করেন, ‘‘ঢাকা বিশ্বের অন্যতম একটি মাইগ্রেন্ট ডমিনেটেড শহর৷ একসময় কোলকাতা এরকমই ছিলো৷ মুম্বাই, দিল্লিও এরকম অভিবাসীদের শহর৷ ডেভেলপিং কান্ট্রির মধ্যে নাইজেরিয়ার শহরগুলো এরকম৷ আফ্রিকার অন্যান্য শহরও এরকম৷ এক সময় ব্যাংককও এরকম ছিলো৷”

আদিল মোহাম্মদ খানও মনে করেন ঢাকা একটি অভিবাসীদের শহর৷ তাদের মতে, সুষম উন্নয়ন না হওয়ায় চাকরি, জীবিকা ও কাজ ও ব্যবসার জন্য সবাই ঢাকামুখী৷ দেশ আরো উন্নত ও সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত হলে এই পরিস্থিতি বদলে যাবে বলে তার আশা৷

এসএইচ-১২/১২/১৯ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)