সংকটের মধ্যে গ্যাস রপ্তানি!

দেশের সমুদ্রে পাওয়া গ্যাস বিদেশি সংস্থাগুলোকে উত্তোলন করে তা রপ্তানি করার সুযোগ করে দিয়েছে সরকার।

মন্ত্রিসভা কমিটির অর্থনৈতিক বিভাগ সম্প্রতি নতুন এই অফ-শোর প্রোডাকশন শেয়ারিং মডেল ২০১৯ এর অনুমোদন দেয়।

২০০৮ সালেও এই উৎপাদন বণ্টন চুক্তি করা হয়েছিল যেটা ব্যাপক আন্দোলনের মুখে ২০১২ সালে বাতিল হয়ে যায়।

দেশ যখন গ্যাস সংকটে ভুগছে তখন দেশের ভেতরে সক্ষমতা তৈরির পরিবর্তে গ্যাস রপ্তানির অনুমোদন দেয়া দেশের স্বার্থ বিরোধী সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেন তেল-গ্যাস রক্ষা আন্দোলনের সমর্থক মির্জা তসলিমা সুলতানা।

“আমাদের গ্যাসের দাম কয়েকদিন পর পর বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। গ্যাসের ব্যবহার সীমিত করে আনা হচ্ছে। এমন অবস্থায় কেন গ্যাস রপ্তানির কথা আসবে?” প্রশ্ন রাখেন মিসেস সুলতানা।

তিনি জানান, বাংলাদেশে গ্যাসের মজুদ দিন দিন ফুরিয়ে আসছে। যার কারণে ভবিষ্যতে সমুদ্রের গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে।

কিন্তু ভবিষ্যতের এই মজুদ সংরক্ষণ না করে রপ্তানির সিদ্ধান্তকে ‘আত্মঘাতী’ বলে মনে করছেন তিনি।

“বিদেশের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে এই গ্যাস উত্তোলনের জন্য দেশের ভেতরেই সরকার প্রশিক্ষিত বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে পারে, অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারে। ততোদিনে সমুদ্রের নীচের গ্যাস তো আর উড়ে যাবে না।”

মির্জা তসলিমার এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

তিনি জানান যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ গ্যাসের চাহিদা পূরণের আগ পর্যন্ত কোন গ্যাস রপ্তানি করা হবে না।

নতুন অফ-শোর উৎপাদন বণ্টন চুক্তির মডেলে বলা আছে যে গ্যাস উত্তোলনের পর সবার আগে পেট্রোবাংলাকে গ্যাস কেনার প্রস্তাব দেয়া হবে।

পেট্রোবাংলা না কিনলে তখনই তা রপ্তানি করা হবে। কাজেই এই সিদ্ধান্তে দেশ লাভবান হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

“আমাদের গ্যাসের শর্টেজ আছে বলেই আমরা ইমপোর্ট করছি। এখন ভবিষ্যতে যদি সমুদ্র থেকে গ্যাস উত্তোলন করা যায় তাহলে আমদানিটা কমে আসবে। তখন সমুদ্রের গ্যাসটা আমরা কিনবো,” বলেন নসরুল হামিদ।

”এখন আমাদের চাহিদা পূরণ করার পর যদি অতিরিক্ত থাকে তাহলে সেটাই এক্সপোর্ট করা হবে। এতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে।”

বাংলাদেশের অধিকাংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, সার কারখানা থেকে শুরু করে ছোট-বড় শিল্প এমনকি গৃহস্থালি গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল।

গ্যাসের এই অতিরিক্ত চাহিদা মোতাবেক বাংলাদেশে যে পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করা হয় সেটি পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এক্ষেত্রে সমুদ্রে গ্যাসের উৎসের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানোর ওপর তারা জোর দেন।

বাংলাদেশের সমুদ্র-সীমায় চিহ্নিত ২৬ টি ব্লকের মধ্যে মাত্র চারটি ব্লকে গ্যাস উত্তোলনের কাজ চলছে।

বাকি ২২টি ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য নির্ভর করতে হবে বিদেশি কোম্পানিগুলোর উপর।

এই বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে গ্যাস রপ্তানির সুযোগ রাখা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ তামিম।

“যেকোনো ব্যবসায় যদি আপনি বিনিয়োগ করেন তাহলে আপনার লক্ষ্য থাকবে বিনিয়োগ খরচ তুলে নেয়া। এরপর প্রফিট করা। না হলে তো কেউ বিনিয়োগ করবে না,” বলছেন মি: তামিম।

”বিদেশি কোম্পানিগুলোর কথাও তাই। তাদের কাছে এটা ব্যবসা। এখন এই সুযোগ যদি আমরা তাদেরকে না দেই তাহলে তো তারা বিনিয়োগ করবেনা।”

“আর এখানে আরেকটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তারা যদি গ্যাসক্ষেত্র পায় তাহলেই বাংলাদেশ বিনিয়োগের অর্থ শেয়ার করবে। কিছু যদি পাওয়া না যায় সেটার ক্ষতির ভাগ বাংলাদেশকে নিতে হবে না। তো এখানে আমার মনে হয় না যে হারানোর কিছু আছে।”

তিনি জানান, গ্যাস উত্তোলনের পর বাংলাদেশ তাদের চাহিদামত গ্যাস কিনতে পারবে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে যদি বলা হয় যে আগামী ৫ বছর আমার গ্যাস কেনার ক্ষমতা নাই বা গ্যাসের প্রয়োজন নাই। অথবা গ্যাসের দাম এতো বেড়ে যাচ্ছে যে ওই মুহূর্তে হয়তো কিনতে পারছেনা। তখন বলা হচ্ছে যে তারা সেই গ্যাস রপ্তানি করতে পারবে।

বর্তমানে গ্যাসের যে সংকট চলছে সেটা দূর করতে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে রপ্তানির এই সুযোগ করে দেয়া সরকারের যৌক্তিক সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেন মিস্টার তামিম।

তবে, চুক্তিতে বাংলাদেশের হিস্যা কতোটুকু হবে। প্রফিট গ্যাসের কতোটুকু অংশ বাংলাদেশ পাবে এবং কেমন দামে বাংলাদেশ কিনবে সে বিষয়গুলো আরও বিস্তারিত হয়ে সামনে আসার প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন এক হাজার মিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাসের ঘাটতি আছে। সামনে এটা আরও বাড়বে।

এরমধ্যে মেঘনাঘাটে ৭১৮ মেগাওয়াটের যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করা হয়েছে সেখানে জ্বালানি চাহিদা মেটানো হবে পেট্রোবাংলার গ্যাস থেকে।

রোববার ভারতের রিলায়েন্স পাওয়ারের সাথে এই চুক্তি করে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড- পিডিবি।

চরম সঙ্কটেও এই গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ-কেন্দ্র নির্মাণ প্রক্রিয়াকে দেশের স্বার্থ বিরোধী সিদ্ধান্ত বলে মন্তব্য করেছেন তেল-গ্যাস রক্ষার আন্দোলনকারীরা।

এসএইচ-০৪/০৪/১৯ (সানজানা চৌধুরী, বিবিসি)