ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’

ঢাকায় দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে উঠতি কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’৷ স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরোনোর আগেই কিশোরদের একটা অংশের বেপরোয়া আচরণ এখন পাড়া মহল্লায় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷

এই ‘গ্যাং কালচারে’ জড়িত থাকার অভিযোগে গত দুই মাসে দুই শতাধিক কিশোরকে আটক করে সংশোধনাগারে পাঠিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী৷ সর্বশেষ গত বুধবার ঢাকার মোহাম্মদপুরে ‘কিশোর গ্যাং’ বিরোধে একজন খুন হয়৷

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে উদ্ভট উদ্ভট সব নাম দিয়ে খোলা হয়েছে এসব গ্রুপ৷ ঢাকায় অর্ধশত ‘কিশোর গ্যাং’ এর নাম আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে রয়েছে৷ মোহাম্মদপুরে খুন হওয়া কিশোরটি ‘ফিল্ম ঝির ঝিল’ গ্যাং এর সদস্য ছিল৷ আর ‘আতঙ্ক’ গ্যাং এর সদস্যরা তাকে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে৷

২০১৭ সালের জানুয়ারিতে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে আদনান কবির হত্যার পর এই ‘গ্যাং কালচারের’ বিষয়টি সামনে আসে৷ এর পর এসব গ্রুপের ব্যাপ্তি বেড়েছে৷ ১৫-২০ বছর বয়সী কিশোরদের প্রতিটি গ্রুপে ১০ থেকে ২০ জন করে সদস্য থাকে৷

কিশোর অপরাধ নিয়ে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন৷ তিনি  বলেন, ‘‘কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা আগেও ছিল, এখনো আছে৷ আগে তারা বখাটেপনা বা মেয়েদের উত্যক্ত করত৷ এখন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে৷

এর বড় কারণ পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ না থাকা৷ এরপর বলব, সামাজিক নিয়ন্ত্রণ নেই৷ আগে গ্রামের মুরুব্বিকে সবাই ভয় পেত৷ এখন নগরায়নের ফলে মুরুব্বিদের তারা ভয় পায় না, উল্টো মুরুব্বিরাই তাদের ভয় পায়৷ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও নানা কাজে ব্যস্ত থাকে৷ তারা এখানে খুব একটা মনোযোগ দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না৷ পাশাপাশি এখন তো খেলার মাঠ নেই৷ তাই সবার হাতে এখন মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট৷ তারা ইন্টারনেটে মারামারির গেম খেলছে, হরর ফিল্ম দেখছে, এগুলো তাদের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে৷”

ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ওয়াহেদুল ইসলাম বলেন, মোহাম্মদপুরে যে ঘটনাটি ঘটেছে সেখানে দুই কিশোর গ্যাং গ্রুপের অধিকাংশ সদস্য স্কুলে অনিয়মিত বা স্কুল থেকে ঝড়ে পড়া৷ এদের অধিকাংশই বখে যাওয়া কিশোর৷ আমরা এমন পাঁচ কিশোরকে আটক করেছি৷ কিশোর গ্যাংগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলছে৷

র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট সারওয়ার আলম বলেন, গত দুই মাসে আমরা অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের দুই শতাধিক সদস্যকে আটক করে সংশোধনাগারে পাঠিয়েছি৷ ২৪ আগস্ট রায়েরবাজার ও মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ‘স্টার বন্ড গ্রুপের’ ১৭ সদস্যকে আটক করে এক বছর করে সাজা দেওয়া হয়৷ একই দিন বংশালে ‘জুম্মন গ্রুপের’ প্রধানসহ পাঁচ সদস্যকে ধরা হয়৷ ২৫ আগস্ট মুগদায় অভিযান চালিয়ে ‘চান-জাদু (জমজ ভাই) গ্যাং’, ‘ডেভিল কিং ফুল পার্টির’, ‘ভলিয়ম টু ও ভাণ্ডারি’ গ্রুপের ২৩ সদস্যকে গ্রেফতার করে সাজা দেওয়া হয়েছে৷

জাতীয় মানষিক স্বাস্থ্য ইনস্টিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, একটা ঘটনা বলি, একটি ছেলে একটি মেয়েকে উত্যক্ত করত৷ মেয়েটির বড় বোন ছেলেটিকে গিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে৷ এটি একটি রাস্তার উপরের ঘটনা৷ ছেলেটি মেয়েটির বোনকেও অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করল৷ ওই রাস্তা দিয়ে বহু মানুষ হেঁটে যাচ্ছেন৷ কেউ প্রতিবাদ করলেন না৷ আসলে আগে অপরাধ করলে অপরাধীরা ভয়ে থাকত৷ আর এখন অপরাধীদের ভয়ে সাধারণ মানুষ ভয়ে থাকেন৷

‘‘এইসব গ্যাং কালচারের কিশোরদের অধিকাংশই মাদকসেবী৷ মাদক এমন একটি জিনিস সেটা ব্রেনের নার্ভকে নষ্ট করে দেয়৷ ফলে তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে৷ বা মুহুর্তেই সে উত্তেজিত হয়ে পড়ে৷ এসব কারণে কিশোরদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে এবং খুনোখুনির ঘটনা বেশি হচ্ছে৷”

গত ৩১ আগস্ট ঢাকার লালবাগ কেল্লায় আশুরায় ঢোল বাজানো নিয়ে বিতর্কের জের ধরে রনি হাসান নামের এক কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে আরেক কিশোর গ্রুপ৷

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ইন্সপেক্টর জুয়েল মিয়া বলেন, এই কিশোররা সংঘবদ্ধ হওয়ায় অনেকেই মনে করেন, এদের পেছনে কোনো গডফাদার বা প্রভাবশালী কেউ রয়েছে৷ ফলে কেউ এদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না৷ অনেক সময় আমরা তদন্তে গিয়ে দেখেছি, সত্যি সত্যি এরা গডফাদারের আর্শিবাদপুষ্ট৷

এসএইচ-০৭/০৭/১৯ (সমীর কুমার দে, ডয়চে ভেলে)