কমছে পোশাক রপ্তানি, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারখানা

দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি কমছে৷ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ছোট আকারের কারখানা৷ কাজ হারাচ্ছেন শ্রমিকরা৷ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, চাহিদা কমা এবং পোশাকের দাম না বাড়ায় এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা গেছে৷

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল-জুন এই তিন মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি তার আগের তিন মাসের তুলনায় ৭ দশমিক ৭২ ভাগ কমেছে৷ যদিও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে পাঁচ দশমিক ১৬ ভাগ৷

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী এই বছরের জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত প্রবৃদ্ধি ধারা অব্যাহত ছিল৷ কিন্তু আগস্ট-সেপ্টেম্বরে তা আর ধরে রাখা যায়নি৷ গত বছরের তুলনায় আগস্টে রপ্তানি কমেছে ১২ ভাগ আর সেপ্টেম্বরে কমেছে পাঁচ ভাগ৷

চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের পোশাক খাতে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮২০ কোটি ডলার৷ যা গত বছরের তুলনায় ১১ দশমিক ৯১ ভাগ বেশি৷ এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে এখন সংশয় দেখা দিয়েছে৷

দেশের মোট রপ্তানি আয়ের সিংহভাগই আসে তৈরি পোশাক থেকে৷ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮৩ ভাগ আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৪ ভাগই যোগান দিয়েছে এই খাত৷

বর্তমানে পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে চীনের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান৷ এই বাজারের শতকরা ৬ ভাগই নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশের কারখানাগুলো৷ কিন্তু এই অবস্থান ধরে রাখা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে৷ তৃতীয় অবস্থানে থাকা ভিয়েতনামসহ অন্যদের সাথে বাংলাদেশকে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে৷

দেশের কারাখানাগুলো ক্রমশ কার্যাদেশ হারাচ্ছে বলে দাবি করে আসছেন মালিকরা৷ তবে এর পরিমান কেমন তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই৷ বিজিএমইএ’র একজন কর্মকর্তা জানান, ‘‘আমরা মালিকদের কাছ থেকে অর্ডার হারানোর কথা শুনি৷ তবে কতজন মালিক কী পরিমান অর্ডার হারিয়েছেন সেই হিসাব আমাদের কাছে নেই৷”

বিজিএমইএর পরিচালক রেজওয়ান সেলিম বলেন, ‘‘আমরা যে অর্ডার হারাচ্ছি তা সত্য৷ মিয়ানমার গত বছর ১০ বিলিয়ন ডলার পোশাক রপ্তানি করেছে৷ তার আগের বছর রপ্তানি করেছে চার বিলিয়ন ডলারের৷ এই ব্যবসা বাংলাদেশ থেকেই গিয়েছে৷ এখন পাকিস্তানের ব্যবসা বাড়ছে৷ আমাদের অবস্থা ভালো না৷”

এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি দাবি করেন, ‘‘গত জানুয়ারিতে শ্রমিকদের যে বেতন বেড়েছে তার সঙ্গে ছোট কারখানা তাল মিলাতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে৷ কিছু বড় কারখানাও লে অফে বাধ্য হয়েছে৷ এর সাথে বাজার মন্দা, পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়া, দাম কমে যাওয়া অন্যতম কারণ৷ টাকার সাথে ডলারের অবমূল্যায়নও ঠিক মতো হচ্ছে না৷ পাকিস্তান, ভারত, চীনসহ আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক দেশে যেভাবে কারেন্সি ডলারের বিপরীতে অবমূল্যায়ন করেছে আমাদের সেরকম হয়নি৷ ফলে আমাদের তুলনায় তাদের পোশাক সস্তা হচ্ছে৷”

বিজিএমইএর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এ পর্যন্ত ৫০টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যেগুলো মূলত ছোটো আকারের৷ এসব কারখানায় গড়ে পাঁচশ থেকে ছয়শ শ্রমিক কাজ করতেন৷ সেই হিসেবে কমপক্ষে ২৫ হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন গেল ছয় মাসে৷

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডরেশনের সভাপতি জনাব আমিরুল হক আমিন বলেন, ‘‘যেসব পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে সেগুলো ছোট৷ এইসব ছোট ছোট কারখানার বেশ কিছু আছে যারা বড় কারখানার সাথে একীভূত হয়েছে, আবার নতুন বড় কারখানাও গড়ে উঠছে৷ তাই বাস্তবে পরিস্থিতি অতটা খারাপ না৷ ২৫ হাজার শ্রমিক আসলে বেকার নেই৷ তাদের বড় একটি অংশ একীভূত হয়ে যাওয়া কারখানায় কাজ পাচ্ছে৷ কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি ভালো নয়৷”

তিনি বলেন, ‘‘পোশাক শিল্পের মালিকরা এই পরিস্থিতির জন্য উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়াকে বড় কারণ হিসেবে সামনে আনছেন৷ শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো নিয়ে কথা বলছেন৷ আসলে এটা ঠিক নয়৷ কেউ কেউ তাদের ব্যবস্থাপনা ত্রুটির জন্য মার্কেট হারাচ্ছে৷ ক্রেতাদের চাহিদা অনুয়ায়ি তারা কারখানা আপগ্রেড না করায়ও বন্ধ হয়ে গেছে৷”

রানা প্লাজা ধ্বসের পর ২০১৩ সালে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স নামের দুইটি জোট গঠন করে বিভিন্ন ব্র্যান্ড ও রিটেইলার প্রতিষ্ঠানগুলো৷ বাংলাদেশ সরকার ও কারখানা মালিকদের সাথে তারা পাঁচ বছর মেয়াদী চুক্তি করে৷ নেয়া হয় কারখানাগুলোর সংস্কার উদ্যোগ৷ যেসব কারখানা সময়মত সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে জোটের সদস্যগুলো৷ ঐ কারখানাগুলো ক্রয় আদেশ না পাওয়ায় কার্যক্রম বন্ধ করে দিতেও বাধ্য হয়েছে৷

বাংলাদেশে ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে পোশাক কারখানার সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার ৮৭৬টি, যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৬২১টিতে৷ চার বছরে মোট বন্ধ হয়েছে এক হাজার ২৫৫ টি৷ বিজিএমই’র তথ্য মতে, চার বছরে পোশাক খাতে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১৮ শতাংশের মত৷ অন্যদিকে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে পোশাকের দাম কমেছে গড়ে ৭ শতাংশ৷ পোশাকের চাহিদাও কমেছে আট শতাংশ৷ যার প্রভাব পড়েছে শিল্পে৷

বর্তমানে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে ৪০ লাখের মতো শ্রমিক কাজ করেন, যার অধিকাংশই নারী৷ তবে অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির কারণে শ্রমিকের চাহিদাও দিন দিন কমছে৷

এসএইচ-০৭/১৫/১৯ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)