বিহারিরা আছে কেমন?

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দুর্দশার দিকে মনোনিবেশ করলেও ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে বাংলাদেশে পাড়ি জমানো বিহারি মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র অনেকেরই অজানা৷

ভারতের পূর্বরাজ্য বিহার থেকে বাংলাদেশে আসা অবাঙালি মুসলমানদের দেশটিতে ‘বিহারি’ নামে ডাকা হয়৷ সরকারি তথ্যানুযায়ী, দেশটির ১৩টি জেলার ১১৬টি ক্যাম্পে এরা বাস করেন৷ এরমধ্যে ঢাকার ৪৫টি ক্যাম্পে ‘মানবেতর’ জীবনযাপন করছেন এক লাখ বিহারি৷

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে জন্ম নেয় পাকিস্তান৷ সেসময় বিহার থেকে অনেক মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ এখনকার বাংলাদেশে চলে যান৷ শোষণ ও বঞ্চনার পিষ্ট বাঙালিরা ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেন৷ পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা ও জাতিগত সমস্যাও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ জড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ৷

উর্দুভাষী বিহারীরা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিলেও পাকিস্তানে যেতে ব্যর্থ হন৷ ইসলামাবাদের পক্ষে সমর্থন জানানোয় বাংলাদেশিরাও তাদের আর বিশ্বাস করে না৷ ফলে সমাজে বিহারিদের অন্তর্ভূক্ত করতে কেউই কোনো পদক্ষেপ নেয়নি৷

বিহারিদের ভাষ্য, ক্যাম্পগুলোর ছোট ছোট কক্ষে তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়৷ একটু বৃষ্টি হলেই সেখানে নানান ধরনের সমস্যা মোকাবেলা কবতে হয় তাদের৷ শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় তারা ভালো চাকরিও পান না৷ সংখ্যালঘু পরিষদের প্রধান নির্বাহী খালিদ হোসেন বলেন, ‘‘সরকারি অফিসে উচ্চতর পদে কোনো বিহারি পাবেন না, কারণ তারা সেজন্য যোগ্যও নন৷”

ফলে বিহারিরা নরসুন্দর, কসাই, রিকশা চালক, পরিবহন শ্রমিক, অটোমোবাইল মেকানিকের মত ছোট ছোট কাজ করে উপার্জন করতে বাধ্য হন৷ বিহারি পরিবারের শিশুদেরও তাড়াতাড়ি কাজ যোগ দিতে হয়, কারণ সন্তানদের শিক্ষিত করার মত আর্থিক সক্ষমতা তাদের নেই৷

সুপ্রিম কোর্টের ২০০৮ সালের একটি আদেশ অনুযায়ী, বিহারিদের জাতীয় ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা থাকলেও তা হয়নি৷ বেশিরভাগ বিহারি বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য যোগ্য নন৷ কারণে তারা অস্থায়ী ক্যাম্পে বাস করেন৷ বাংলাদেশের নিয়মানুযায়ী, পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য আবদেনকারীকে তার স্থায়ী ঠিকানা সরবরাহ করতে হয়৷

উর্দু-ভাষীদের পুনর্বাসন আন্দোলনের সভাপতি সাদাকাত খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমরা পাঁচ দশক ধরে অমানবিক জীবনযাপন করছি, নূন্যতম সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছি৷ আমাদের সন্তানদের মধ্যে কেবল পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পায়৷ আমরা আমাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সক্ষমতা অর্জন করতে চাই, আমরা আমাদের সন্তানদের স্কুলে যেতে দেখতে চাই৷”

বিহারিদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে আর্থিক সহায়তা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে৷ ফলে এদের এখনো বাংলাদেশের বিপক্ষের মানুষ বলেই বিবেচনা করা হয়৷

খালিদ হোসেন নামে একজন মুসলিম বিহারি বলেন, “আমরা ক্যাম্পগুলোতে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস না করে সমাজে অন্তর্ভুক্ত হতে চাই৷ আমাদের বাংলাদেশবিরোধী বলে যে তকমা দেয়া হয় তা থেকেও বেরিয়ে আসতে চাই আমরা৷”

সরকার সম্প্রতি বিহারিদের ঢাকা থেকে অন্য অঞ্চলে স্থানান্তরের পরিকল্পনার কথা জানায়৷ সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী, এক হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করে সেখানে বহুতল ভবন তৈরি করে বিহারিদের রাখা হবে৷

এই পরিকল্পনাটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে জানিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য শামীমা নার্গিস ডয়চে ভেলেকে বলেন, এই পরিকল্পনাকে সামনে রেখে সরকার সম্ভাব্যতা যাচাই করছে৷

তবে বিহারীরা সরকারের এই পরিকল্পনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে৷ তারা বলছেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে বিহারিদের সমাজ থেকে আরো বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হবে৷

এসএইচ-০৭/১৯/১৯ (অনলাইন ডেস্ক, ডয়চে ভেলে)