আওয়ামী লীগের গলার কাঁটা প্যাডসর্বস্ব সংগঠন ?

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলটির সহযোগী সংগঠনের সংখ্যা সাতটি।

এগুলো হলো মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, বাংলাদেশ আওয়ামী যুব লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, তাঁতী লীগ ও যুব মহিলা লীগ।

এর বাইরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক নেত্রী আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।

কিন্তু আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র বলছে, ‘এ দুটি সংগঠন তাদের স্ব স্ব সংগঠনের গঠনতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হবে’।

কিন্তু বাস্তবতা হলো এসব সংগঠনের বাইরে অসংখ্য সংগঠন আওয়ামী বা লীগ শব্দ যুক্ত করে নানা সংগঠন তৈরি করেছে গত এক দশকে।

দল বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু নেতা মূলত পেছন থেকে এসব সংগঠন তৈরি করেন নিজেদের প্রচারের স্বার্থে।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে এমন কয়েকটি সংগঠনের কার্যকলাপ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার জের ধরে শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এক সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে দলটির ছয় সহযোগী সংগঠন ছাড়া কেউ নামের সাথে ‘লীগ’ শব্দটি যোগ করতে পারবেনা।

সর্বশেষ গত মাসের প্রথম সপ্তাহে তাঁতী লীগের এক অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, “বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার নাম বা ছবি ব্যবহার করে কেনো রাজনৈতিক দোকান খেলা যাবেনা”।

এর কারণ হলো আওয়ামী লীগ থেকে বারবার শক্ত ব্যবস্থার কথা বলা হলেও আওয়ামী, বঙ্গবন্ধু, জননেত্রী, কিংবা লীগ শব্দ ব্যবহার করে সংগঠনের সংখ্যা খুব বেশি কমানো যায়নি।

এ ধরণেরই একটি সংগঠন ‘জননেত্রী পরিষদ’। মাঝে মধ্যেই নানা ইস্যুতে আলোচনা সভা করতে দেখা যায় তাদের এবং এসব অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের মধ্যম সারির নেতারা যোগও দেন।

কিন্তু শেখ হাসিনার নামের আগে ব্যবহৃত শব্দ দিয়ে সংগঠন খোলার জন্য আওয়ামী লীগ থেকে অনুমোদন নেয়া হয়েছে কি-না এমন প্রশ্নের জবাব মেলেনি সংগঠনটির নেতা মনির খানের কাছ থেকে।

এ সংগঠনের কার্যক্রম চলমান কি-না জিজ্ঞেস করলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, “থাকবেনা কেন?”

কিন্তু আওয়ামী লীগের কোনো অনুমতি তাদের আছে কি-না জানতে চাইলে তিনি পরে কল দিবেন বলে ফোন কেটে দেন।

তবে ‘আওয়ামী উদ্যোক্তা লীগে’র প্রধান সমন্বয় কারী জসীমউদ্দিন রুমান বলছেন তারা এই সংগঠনের কার্যক্রম বন্ধ রেখেছেন।

“আমরা আওয়ামী লীগের দফতর বরাবর চিঠি দিয়ে কোনো সাড়া পাইনি। তাছাড়া সংগঠনটি খোলার পর সিনিয়ররা বকাবকি করেছেন। তাই বন্ধ করে দিয়েছি”।

তিনি বলেন আরও অনেক সংগঠনের দেখাদেখি তারা উদ্যোক্তা লীগ খুলেছিলেন কিন্তু পরে বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

“অনেকেই অনেক ধরণের সংগঠন করেছে। তাই আমরাও ভেবেছিলাম আর কি। সিনিয়ররা বকা দিলো। এখন যদি জিজ্ঞেস করেন, সেই সিনিয়র কারা? সেটা আমি বলতে পারবোনা,” বলছিলেন মিস্টার রুমান।

তবে ২/৩ বছর আগেও আওয়ামী লীগের নাম যুক্ত করে নাম রাখা কয়েকটি সংগঠন বেশ আলোচনার জন্ম দেয়।

এমন কয়েকটি হলো আওয়ামী অভিভাবক লীগ, আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, শিশু কিশোর লীগ।

দলীয় স্বীকৃতি না থাকলেও নাম সর্বস্ব এসব সংগঠনের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক তদবিরের অভিযোগ উঠে।

তবে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের উপ দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া বলছেন, জাতির পিতা বা পরিবারের সদস্যদের নামে সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান করার সুনির্দিষ্ট বিধান আছে। এর বাইরে কেউ কিছু করলে সেটি বেআইনি হবে।

“জাতির পিতা বা জাতির পিতার পরিবারের সদস্যদের নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল বা এমন কোন জনহিতকর প্রতিষ্ঠানের জন্য বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অনুমতি নেয়া বাধ্যতামূলক । তাদের অনুমোদন ছাড়া নাম ব্যবহার করা সম্পূর্ণ বেআইনি। কেউ এমন কিছু করলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা আছে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকেও”।

মি. বড়ুয়া বলছেন, এছাড়া আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নামগুলো দেয়া আছে।

“তবে এর বাইরেও বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও শেখ রাসেল শিশু কিশোর পরিষদের মতো কিছু সংগঠন ৭৫ এরপর বৈরি পরিবেশে তখনকার রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রচার করেছে। গঠনতন্ত্রে না থাকলেও আমরা তাদের রাজনৈতিকভাবে স্বীকৃতি দেই”।

প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী অবশ্য স্বীকার করেন যে এসবের বাইরেও গত দশ বছরে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার সুযোগে বেশ কিছু ‘ভুঁইফোড় ও প্যাডসর্বস্ব সংগঠন’ গজে উঠেছে।

“এদের নানা সময়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলা হয়েছে আওয়ামী লীগের নাম ভাঙ্গিয়ে কেউ যেনো অন্যায় কিছু না করতে পারে”।

কিন্তু এতো হুঁশিয়ারি ও সতর্কতা সত্ত্বেও নিত্য নতুন গড়ে উঠছে নানা সংগঠন।

বিভিন্ন উপলক্ষে নগরীর বিভিন্ন জায়গা নিয়মিতই যাদের ব্যানার পোস্টার দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে:

মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, জাতীয় শিশু কিশোর লীগ, বাংলাদেশ আওয়ামী তৃণমূল লীগ, বাংলা আওয়ামী সোনার বাংলা লীগ, আওয়ামী হকার্স লীগ, আওয়ামী বাস্তুহারা কল্যাণ সমিতি, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, আওয়ামী সমবায় লীগ, আওয়ামী শিশু লীগ, আওয়ামী প্রচার লীগ, আওয়ামী তৃণমূল লীগ, আওয়ামী ছিন্নমূল হকার্স লীগ, মোটর চালক লীগ, আওয়ামী তরুণ লীগ, আওয়ামী রিকশা মালিক শ্রমিক ঐক্য লীগ, আওয়ামী পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা লীগ, আওয়ামী নৌকার মাঝি লীগ, আওয়ামী ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী লীগ, আওয়ামী যুব সাংস্কৃতিক জোট, আওয়ামী পর্যটন লীগ, বঙ্গবন্ধু বাস্তুহারা লীগ, বঙ্গবন্ধু আদর্শ পরিষদ, বাংলাদেশ আওয়ামী অনলাইন লীগ, বিশ্ব আওয়ামী অনলাইন লীগ, বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ, জননেত্রী পরিষদ, দেশরত্ন পরিষদ, নৌকার সমর্থক গোষ্ঠী, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, আওয়ামী হকার্স ফেডারেশন, আওয়ামী তৃণমূল লীগ, আওয়ামী যুব হকার্স লীগ, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ, বঙ্গমাতা পরিষদ, আওয়ামী নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, ডিজিটাল আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ, মুক্তিযোদ্ধা তরুণ লীগ, বঙ্গবন্ধু গ্রাম ডাক্তার পরিষদ, জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় লীগ, আমরা মুজিব হবো, জননেত্রী শেখ হাসিনা কেন্দ্রীয় সংসদ, আওয়ামী ছিন্নমূল হকার্স লীগ, আওয়ামী তরুণ লীগ, ডিজিটাল আওয়ামী ওলামা লীগ, আওয়ামী রিকশা মালিক-শ্রমিক ঐক্য লীগ, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ, আওয়ামী ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী লীগ, আওয়ামী পর্যটন লীগ, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা পরিষদ, তৃণমূল লীগ, চেতনায় মুজিব, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, ছিন্নমূল মৎস্যজীবী লীগ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লীগ, নৌকার নতুন প্রজন্ম, ডিজিটাল ছাত্রলীগ, ২১ আগস্টের ঘাতক নির্মূল কমিটি, সজীব ওয়াজেদ জয় পরিষদ, বঙ্গবন্ধুর সৈনিক, বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্মচারী লীগ, দেশীয় চিকিৎসক লীগ, নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, ঘাট শ্রমিক লীগ, আমরা নৌকা প্রজন্ম, নৌকা সমর্থক গোষ্ঠী, নৌকার নতুন প্রজন্ম, ডিজিটাল ছাত্রলীগ, ডিজিটাল বাংলাদেশের মতো বাহারি নামের নানা সংগঠন।

এসএইচ-০৭/০৫/১৯ (রাকিব হাসনাত, বিবিসি)