র‌্যাবের অনুসন্ধান সমকামীরা অপরাধি চক্রের হাতে জিম্মি

নাইমুর রহমানের (ছদ্মনাম) বাড়ি ঢাকা শহরের পাশেই। যেহেতু তিনি একজন সমকামী, সেজন্য নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তার নাম এবং বসবাসের স্থান উল্লেখ করা হচ্ছে না।

গত মে মাসের মাঝামাঝি তার ফেসবুক মেসেঞ্জারে একটি বার্তা আসে।

সে বার্তার মাধ্যমে অন্য আরেক ব্যক্তি নিজকে সমকামী হিসেবে পরিচয় দিয়ে নাইমুর রহমানের সাথে বন্ধুত্বের আগ্রহ প্রকাশ করে।

নাইমুর রহমান নিজেও বেশ কিছুদিন যাবত অনলাইনের মাধ্যমে একটি সমকামী ছেলে বন্ধুর খোঁজ করছিল। তিনি জানান, তার মতো অনেকেই বিভিন্ন অনলাইন সাইটে সমকামী বন্ধুর খোঁজ করে।

মেসেঞ্জারে বন্ধুত্বের প্রস্তাব আসা মাত্র নাইমুর রহমান বেশ দ্রুততার সাথে সাড়া দেন। এক পর্যায়ে দুজনে দেখা করার জন্য একটি স্থান এবং সময় নির্ধারণ করেন।

“আমার মেয়েদের ভালো লাগে না। সেজন্য আমি সেই ছেলে বন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। কোন যৌন সম্পর্ক করার জন্য যাইনি। শুধু বসে গল্প করতে চেয়েছিলাম,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন নাইমুর রহমান।

নির্ধারিত দিনে দেখা করতে যাবার পর নাইমুর রহমানকে একটি বাড়িতে নিয়ে যান তার কথিত সেই ছেলে বন্ধু।

এরপর তাকে সেখানে আটকে রেখে মোবাইল ফোন, টাকা পয়সা রেখে দেয়। এরপর নাইমুর রহমানকে দিয়ে তাঁর বাবার কাছে ফোন করিয়ে ৪০ হাজার টাকা দাবি করে অপহরণকারীরা।

তাদের সাথে আপসরফা করে মোবাইল ব্যাংকিং-এর মাধ্যমে ১৫ হাজার টাকা পাঠানো হয় অপহরণকারীদের কাছে।

সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে বাসায় ফিরে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‍্যাব-এর কাছে অভিযোগ দায়ের করেন তিনি।

কিন্তু ঘটনার বিস্তারিত নাইমুর রহমান তার বাবা-মা’র কাছে প্রকাশ করেননি। মি: রহমান বলেননি যে সমকামী বন্ধুর খোঁজে বের হয়ে তিনি এ বিপদে পড়েছিলেন।

তিনি বিষয়টিকে শুধুই একটি অপহরণের ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

কিন্তু র‍্যাব-এর কাছে তিনি ঘটনার বিস্তারিত প্রকাশ করেছেন।

“আমার বাবা-মা যদি জানতে পারে যে আমি সমকামী তাহলে তারা আমাকে মেরেই ফেলবে। এটা শুধু আমার রড় বোন জানে। যারা আমাকে জোর করে ধরে আটকে রেখেছিল তারাও সমকামী।” বলছিলেন নাইমুর রহমান।

ঠিক একই কায়দায় গত বুধবার ঢাকা থেকে ত্রিশোর্ধ্ব এক ব্যক্তিকে অপহরণ করার একটি অভিযোগ আসে নারায়ণগঞ্জ কর্মরত র‍্যাব ১১ তে।

সে অপহরণের সূত্র ধরে অভিযান চালিয়ে তিন যুবককে আটক করে র‍্যাব।

র‍্যাব বলছে নাইমুর রহমানকে আটকে রাখার সাথে এ চক্রটির সম্পৃক্ততা ছিল।

র‍্যাব ১১’র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন বিবিসি বাংলাকে বলেন, যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের তারা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে যে তারা নিজেরাও সমকামী।

“অনলাইনে সুদর্শন ছেলেদের ছবি ব্যবহার করার মাধ্যমে তারা সমকামীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে,” বলছিলেন র‍্যাব কর্মকর্তা আলেপ উদ্দিন।

তিনি বলেন, এসব ছবি দেখে সাড়া দিচ্ছেন তাদের সংখ্যাও কম নয়।

র‍্যাব-এর এ কর্মকর্তা বলছেন, সমকামীদের জন্য অনলাইনে ফাঁদ তৈরি করছে সে চক্রটি যেমন বড়, তেমনি এসব ফাঁদে যারা পা দিচ্ছেন তাদের সংখ্যাও বিস্তৃত। উভয় পক্ষই সমকামী বলে দাবি করেন এই র‍্যাব কর্মকর্তা।

“আমরা এ রকম বেশ কিছু ঘটনা পেয়েছি। ভিকটিমরা আমাদের কাছে অভিযোগ করলেও তারা সমাজে লজ্জার ভয়ে প্রকাশ্যে কোন মামলা করতে চায় না,” বলছিলেন আলেপ উদ্দিন।

র‍্যাব বলছে বুধবার রাতে যে তিনজনকে আটক করা হয়েছে তাদের কাছে একটি পিস্তল, তিন রাউন্ড গুলি এবং দুটি চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে।

সেজন্য তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‍্যাব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞানের শিক্ষক ফারজানা ইসলাম বাংলাদেশের সমাজে যেহেতু সমকামিতা গ্রহণযোগ্য নয়, বরং শাস্তিযোগ্য, সেজন্য সমকামীরা তাদের পার্টনার পায় না।

ইন্টারনেটের বিস্তারের কারণে সমকামীদের সঙ্গী খুঁজে পাবার জন্য বিভিন্ন সাইট এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে তিনি মনে করেন।

“যেহেতু তাদের জীবন অবদমিত এবং তারা নিজেদের প্রকাশ করতে পারেনা সেজন্য তারা যখন অনলাইনে কোন অফার পায় তখন বিষয়টি তাদের কাছে সোনার হরিণের মতো। তাদের কমন ইন্টারেস্ট থাকে,” বলছিলেন ফারজানা ইসলাম।

তিনি বলেন, শুধু সমকামীদের সম্পর্ক নয়, বর্তমানে যে কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাইবার স্পেস-এর একটি বড় ভূমিকা আছে।

এসএইচ-০৪/২৩/১৯ (আকবর হোসেন, বিবিসি