ট্রেন দুর্ঘটনার তদন্ত কি স্রেফ নাটক?

দেশের সাম্প্রতিক দুটি ট্রেন দুর্ঘটনা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি দুর্ঘটনা ছিল দুটি ট্রেনের মধ্যে সংঘর্ষ। ওই সংঘর্ষে ১৬ জন মারা যায়। আরেকটি সংঘর্ষে একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে বেশ কয়েকটি বগিতে আগুন ধরে যায়।

এই দুটি ঘটনা কীভাবে হল তা খতিয়ে দেখতে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

বাংলাদেশে সব ট্রেন দুর্ঘটনায় বিভাগীয় তদন্ত কমিটি করা হয় এর কারণ খতিয়ে দেখার জন্য।

কিন্তু এর মধ্যে কতগুলোর প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে?

ট্রেন দুর্ঘটনার পর একাধিক তদন্ত কমিটি করার কথা শোনা যায়, যেমনটি দেখা গেছে সাম্প্রতিক দুটি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে।

কিন্তু তদন্তের পর কী হল সেটা অনেকের কাছে অজানা থাকে।

এসব তদন্তের প্রতিবেদন এবং এর প্রেক্ষিতে দায়ীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হল সেটা অনেকটাই গোপন থাকে।

রেলওয়ে বিভাগের করা একটি প্রতিবেদন রয়েছে যেখানে ঢাকা বিভাগে ২০১৩ এবং ২০১৪ সালের ১৬টি দুর্ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন এসেছে।

যেখানে ঘটনার তারিখ, স্টেশন, ট্রেন নম্বর, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ,দায়ী কর্মচারী/বিভাগ ও শাস্তির বিবরণ দেয়া হয়েছে।

১৬টি দুর্ঘটনার শাস্তির বিবরণে লেখা রয়েছে:

৮ জনকে তিরস্কার করা হয়েছে
৩ জনকে সতর্ক
৪ জনের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে সেটা প্রক্রিয়াধীন
৩টি ঘটনায় কেউ দায়ী নয়
১৮ জনের বিরুদ্ধে সর্বনিম্ন ৪৫০টাকা বেতন কাটা থেকে সর্বোচ্চ ২ বছরের বেতন কেটে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এই প্রতিবেদনে যাদের শাস্তির তালিকায় আনা হয়েছে তারা ট্রেনচালক, সিগনাল-ম্যান, গার্ড এই ধরণের কর্মচারীদের নাম রয়েছে।

রেল-বিভাগের এই ধরনের তদন্ত প্রতিবেদন সাধারণত জনসমক্ষে আসে না।

তবে রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, তদন্ত কমিটিগুলো এমনভাবে গঠন করা হয় যাতে করে এই কমিটিতে যারা থাকে তারা তদন্তে একেবারে নিচের পর্যায়ের ব্যক্তিদের দোষী সাব্যস্ত করতে পারে।

এর ফলে উপরের পর্যায়ে যেসব কর্মকর্তা রয়েছেন,যারা নিয়োগ বা প্রশিক্ষণের দায়িত্বে রয়েছেন তারা সবসময় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যান।

রেলওয়ের মহাপরিচালক মোঃ শামছুজ্জামানের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে আপনারা কী ব্যবস্থা নেন?

উত্তর: ‘তদন্তের আগেই আমরা বুঝতে পারি কাদের কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। সেসব কর্মচারীকে আমরা প্রত্যাহার করি বা সাময়িক বরখাস্ত করি। কারণ আমরা মনে করি সেই মুহূর্তে তাদের যদি আমরা সার্ভিসে রাখি তাহলে আরো দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। তদন্তের পর যদি দেখি তারা দোষী না, তাদের আমরা পুনর্বহাল করি। আর যারা দোষী সাব্যস্ত হয় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থা নেয়’।

প্রশ্ন: কী ধরণের শাস্তি দেয়া হয়?

উত্তর:ঘটনার সাথে তার সংশ্লিষ্টতা এবং দায়-দায়িত্ব বিবেচনায় আমরা পেনাল্টি ইমপোজ করি। আমরা বদলি করা, পদাবনত করা, চাকরীচ্যুতও করি।

প্রশ্ন: কিন্তু একটা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তিরস্কার বা সতর্ক করা হয়েছে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি বলতে আপনারা কি করেন?

উত্তর: ২০১৬তে আমরা দুইজনকে চাকরীচ্যুত করেছি। তারা এখনো চাকরি পায়নি। ২০১৭তে আমরা চাকরীচ্যুত করেছি দোষী কয়েকজনকে।

২০১৮ সালে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের রাসেল আহমেদ – ঢাকা থেকে সিলেটগামী কালনি ট্রেনে দুর্ঘটনায় পড়েন।

সেই দুর্ঘটনায় মি. আহমেদ পায়ে আঘাত পান। চিকিৎসার এক পর্যায়ে তার পা কেটে ফেলে দিতে হয়।

রাসেল আহমেদের ভাই রুহেল আহমেদ বলছিলেন, একজন কর্মক্ষম মানুষ যখন বেকার হয়ে পড়ে তখন তার এবং পুরো পরিবারের জন্য বিষয়টা দুর্বিষহ হয়ে পরে।

তিনি বলছিলেন “আমরা ক্ষতিপূরণ পাইনি। আমরা জানি না ক্ষতিপূরণ কীভাবে পেতে হয়। তবে আমরাও চাইনি। কারণ ক্ষতিপূরণ নেয়ার চেয়ে রেলের যারা এই দুর্ঘটনার সাথে দায়ী তাদের শাস্তি হোক এটাই আমরা চাই। আমরা মনে করি এটা করলে আরো দশটা মানুষের জীবন বাঁচবে”।

বাংলাদেশের রেলের যে আইন রয়েছে সেটা বহু পুরনো ১৮৯০ সালের।

সেখানে দুর্ঘটনায় হতহতদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১০ হাজার টাকা দেয়ার নিয়মের কথা বলা হয়েছে।

বিষয়টা নিয়ে কথা বলেছিলেন রেলের মহাপরিচালকের সাথে।

শামছুজ্জামান বলেছেন এই নিয়মটা পরিবর্তন করে ক্ষতিপূরণ হিসেবে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব করেছেন তারা। সেটা এখন সংসদের এখতিয়ারে রয়েছে।

বাংলাদেশ রেল বিভাগ বলছে ২০১৪সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ এর জুন পর্যন্ত গত ৫ বছর দুর্ঘটনা হয়েছে ৮৬৮টা।

এই দুর্ঘটনাগুলোতে ১১১ জন নিহত এবং আহত হয়েছে ২৯৮জন।

তবে সম্প্রতি দুটো দুর্ঘটনা ধরলে এই সংখ্যা আসে ৮৭০টা।

এই দুর্ঘটনাগুলোতে ১২৭ জন নিহত এবং আহত হয়েছে তিনশর অধিক।

২০১০ সালের ৮ই ডিসেম্বর। বিকাল চারটার সময় মহানগর গোধুলী এবং চট্টলা এক্সপ্রেসের সংঘর্ষ হয় নরসিংদীতে।

দুর্ঘটনায় ১৪জন নিহত এবং শতাধিক আহত হন।

সেই দুর্ঘটনার কারণ, এবং কারা দায়ী সেটা অনুসন্ধানে কাজ করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিডেন্ট এন্ড রিসার্চ ইন্সটিউটের একদল গবেষক শিক্ষক।

তাদের একজন কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ সেই তদন্ত প্রতিবেদনের বিস্তারিত একটা কপি দেখিয়ে বলছিলেন, সেই ঘটনার প্রতিবেদন তারা রেল বিভাগে জমা দিয়েছিলেন।

কিন্তু যেসব, কারণ, সুপারিশ এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা তারা বলেছিলেন তার কোনটাই বাস্তবায়ন করা হয়নি।

তিনি বলছিলেন, “২০১০ সালে আমরা দুর্ঘটনা এড়ানোর যে কারণগুলো উল্লেখ করেছিলাম তার কোনটাই নেয়া হয়নি। একটা বড় বিষয় ছিল ‘ডেড ম্যান প্যাডেল’, যেটা চালককে পা দিয়ে চাপ দিয়ে ধরে রাখতে হয়। কিন্তু আমরা দেখেছি বেশিরভাগ ট্রেনে এটা অকার্যকর। ২০১০ এ এটা ফেল করার কারণে দুর্ঘটনা হয়। একই কারণে আমরা দেখলাম ২০১৯ সালে ১২ নভেম্বর দুর্ঘটনা হল”।

এ বছরের জুনের ২৪ তারিখে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া এলাকায় সিলেট থেকে ঢাকাগামী একটি ট্রেন দুর্ঘটনায় অন্তত পাঁচজন নিহত হয়।

সেই ট্রেনের যাত্রী ছিলেন সিলেটের ওসমানী মেডিকেলের নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থী ফাহমিদা ইয়াসমিন ইভা।

তিনি ঐ ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত হন। ইভার বাবা আব্দুল বারি বিবিসি কে বলেন, রেলমন্ত্রী সেই সময় ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক লাখ টাকা দেন, সাথে ঘর করে দেয়া এবং ইভার ছোট বোনের একটা চাকরি দেয়ার আশ্বাস দেন।

আব্দুল বারি বলছিলেন এক লাখ টাকা তারা পেয়েছেন কিন্তু সন্তান হারানো বেদনা তো টাকা বা বাড়ি দিয়ে হয় না।

তাঁর কাছে এই ক্ষতির কোন ক্ষতিপূরণ নেই। তবে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তিও হয় না বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

এসএইচ-০৪/২৪/১৯ (ফারহানা পারভীন, বিবিসি)