পেঁয়াজের ঘাটতি না থাকলেও দাম চড়া!

যেসব হিসাব পাওয়া যাচ্ছে তাতে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে পেঁয়াজের ঘাটতি নেই৷ উৎপাদন এবং আমদানির হিসাব অনুযায়ী পেঁয়াজ উদ্বৃত্ত হওয়ার কথা৷ কিন্তু তারপরও পেঁয়াজের দাম ১৬০ থেকে ২৪০ টাকার মধ্যেই ওঠানামা করছে৷

ভারতগত ২৮ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেয়৷ এরপর সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি৷ ভারত রপ্তানি বন্ধ করার আগের দিনও পেঁয়াজের কেজি ছিল ৮০ টাকা৷

বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ বিক্রির পাশাপাশি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি মনিটরিং কমিটিও গঠন করেছিল৷ তাদের দায়িত্ব ছিল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে বাজার মনিটর করে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা৷ এছাড়া মিয়ানমার, তুরস্ক, পাকিস্তান, মিশরসহ কয়েকটি দেশ থেকে পেঁয়াজ আমানির উদ্যোগও নেয় সরকার৷

দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন বলে ধরা হয়৷ প্রতি মাসে গড় চাহিদা দুই লাখ টন৷ দৈনিক চাহিদা সাত হাজার টনের কিছু কম৷ আর টিসিবির ৫০টি ট্রাকে প্রতিদিন এক টন করে ৫০ টন পেঁয়াজ খোলাবাজারে প্রতি কেজি ৪৫ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে৷ সাত হাজার টনের বিপরীতে এই ৫০ টন পেঁয়াজ কোনোভাবই বাজার প্রভাবিত করতে পারে না৷ নিম্নবিত্ত মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে কিছু পোঁয়াজ কিনতে পারেন, এই যা৷ এটা শহুরে নিম্নবিত্তদের জন্য, সারাদেশে বা গ্রামের মানুষের জন্য নয়৷

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী গেল বছর (২০১৮-২০১৯ অর্থ বছর) দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৬ লাখ ১৯ হাজার টন৷ কিন্তু এই উৎপাদিত পেঁয়াজের প্রায় ৩০ ভাগ নষ্ট হয়৷ ফলে বছরে ২৪ লাখ টন পেয়াজের চাহিদার বিপরীতে ৮ থেকে ৯ লাখ টন পেঁয়াজের ঘাটতি থাকে৷

তাই অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেবে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ২২ লাখ টন৷ নতুন অর্থ বছরে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে ৪ লাখ ৭২ হাজার টন৷

অক্টোবরে সংকটের পর পেঁয়াজ আমদানির যে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে প্রায় এক লাখ টন পেঁয়াজ আমদানির কথা জানিয়েছেন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের৷ কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই হিসেব নিশ্চিত করতে পারেনি৷ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ বকসি বলেন, ‘‘আসলে কী পরিমাণ পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে তা এখন বলা সম্ভব নয়৷ কারণ, এলসির বাইরেও বর্ডার ট্রেডের মাধ্যমে পেঁয়াজ আনা হয়েছে৷’’

কিন্তু ব্যবসায়ীদের একটি সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপ পেঁয়াজ আমদানির কথা বললেও তারা পেঁয়াজ আনেনি৷ সংবাদমাধ্যমে ওই পেঁয়াজের হিসাবই ছাঁপা হচ্ছে৷ ৪০ হাজার টনের মতো পেঁয়াজ আমদানি হয়ে থাকতে পারে৷ এলসি খুললেইতো আমদানি হয়ে যায় না!’’ ঢাকার শ্যামবাজারের পাইকারি পেঁয়াজ ব্যবসায়ী আব্দুল মাজেদ বলেন, ‘‘এত পেঁয়াজ আমদানির কথা বলা হচ্ছে সেই পেঁয়াজ কোথায়? আমাদের কাছে তো সরবরাহের ঘটতি আছে৷ আর দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসতে আরো ২০ দিন সময় লাগবে৷’’

চট্টগ্রামের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট তৌহিদুল ইসলাম একই কথা বলেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা পেঁয়াজের বাজার মনিটরিং করতে গিয়ে দেখেছি অনেক বড় আমদানিকারকই শেষ পর্যন্ত তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পেঁয়াজ আমদানি করেনি৷” বাজার মনিটরিং প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘আমরা চট্টগ্রামে কাজ করলেও সারাদেশে সিরিয়াসলি কাজ হয়নি৷ আর কারা বাজার অস্থিতিশীল করেছে তাদের ব্যাপারে আমরা তথ্য দিয়ে ব্যাবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছি৷ এখন বাকিটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয়৷’’

সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক, অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘বাংলাদেশে প্রতিদিন সাড়ে ৬ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ লাগে৷ এখন যদি সংকট শুরুর পর থেকে এক লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়, তাহলে মাত্র ১৬ দিনের পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে৷ এই সময়ে আমাদের দেশি পেঁয়াজ থাকে না৷ পুরো চাহিদাই আমদানি করা পেঁয়াজ থেকে মিটাতে হয়৷ সুতরাং পেঁয়াজের ঘাটতি আছে৷ আর টিসিবি’র মাধ্যমে যে পেঁয়াজ দেয়া হয়, তা দিনের মোট চাহিদার খুবই সামান্য অংশ৷’’

তিনি জানান, ‘‘দেশীয় পেঁয়াজ আসতে আরো ২০ দিন সময় লাগবে৷ আর দেশীয় পেঁয়াজ এক সময়ে সব আসে না৷ ধাপে ধাপে আসে৷ তাই এখন আমদানি বাড়াতে হবে৷ আর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সরাসরি পেঁয়াজ আমদানি করতে পারে৷ তারা আমদানির কথা বলেছে৷ এটা শুরু করা উচিত৷’’

তিনি বলেন, ‘‘ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ যে সুযোগ নিচ্ছে না, তা নয়৷ তারা কম দামে আমদানি করে বেশি দামে বিক্রি করছে৷ কিন্তু তাদের দোষ দিয়ে পেঁয়াজের দাম কমানো যাবে না৷ সরবরাহ না বাড়ালে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না৷ আর আমদানি বাড়ালে দেশীয় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আমি মনে করি না৷ কারণ, দেশি পেঁয়াজ একই সময়ে বাজারে আসে না৷’

এসএইচ-০৮/০৪/১৯ (হারুন উর রশীদ স্বপন, ডয়চে ভেলে)