বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন না-থামাটাই ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল!

প্রতিবেশী বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন না-থামাটাই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনার অন্যতম প্রধান কারণ বলে ভারতের সরকার আজ পার্লামেন্টে দাবি করেছে।

বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেওয়ার লক্ষ্যেই আনা হয়েছে এই বিতর্কিত বিলটি।

আর সেটি সোমবার লোকসভায় পেশ করতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশ-সহ তিনটি প্রতিবেশী দেশের সংবিধানকে উদ্ধৃত করে আরও বলেছেন, এই দেশগুলোর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বলেই সেখানে অন্য ধর্মের মানুষরা নিপীড়িত হচ্ছেন।

কংগ্রেস-সহ প্রায় সব বিরোধী দলই অবশ্য এই বিলটির তীব্র বিরোধিতা করছে।

অনেক বিরোধী এমপি-ই প্রশ্ন তুলছেন শ্রীলঙ্কা থেকে আসা তামিল শরণার্থী বা মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারাই বা কেন ভারতের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হবেন?

কূটনৈতিকভাবে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন ‘শ্রেষ্ঠ সময়’ বা ‘সোনালি অধ্যায়ে’র মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দুই দেশের নেতারা প্রায়ই দাবি করে থাকেন।

অথচ ভারতের লোকসভায় আজ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পেশ করতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছেন, এই বিলটি আনতে সরকার বাধ্য হয়েছে তার অন্যতম কারণ সেই বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশেই হিন্দু-বৌদ্ধরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

তিনি বলেন, “বাংলাদেশ থেকে আসা লোকরাও এই বিলের সুবিধা পাবেন।”

“মাননীয় স্পিকার, সে দেশে কিন্তু নরসংহার থামেনি – একাত্তরের পরও বেছে বেছে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে।”

এমন কী, ইসলামি প্রজাতন্ত্র আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতোই বাংলাদেশেও যে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সে কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি।

অমিত শাহ পার্লামেন্টে বলেন, “বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২(ক)-তেও বলা আছে, ওই প্রজাতন্ত্রের ধর্ম হবে ইসলাম।”

“এই তিনটি দেশে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম বলেই সেখানে মুসলিমদের নির্যাতিত হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না – কিন্তু অন্য ধর্মের মানুষরা অত্যাচারের শিকার হতে পারেন।”

তিনি আরও দাবি করেন, সাতচল্লিশে কংগ্রেস যদি ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হতে না-দিত, তাহলে আজ এই বিল আনার কোনও প্রয়োজনই হত না।

বিরোধীরা অবশ্য সরকারের এসব যুক্তি একেবারেই মানতে রাজি নন, তারা মনে করছেন এই বিলটির প্রস্তাবনাই আসলে সংবিধানবিরোধী – এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার পরিপন্থী।

হায়দ্রাবাদের এমপি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি যেমন বিবিসিকে বলেন, “এর মাধ্যমে সরকার তো দ্বিজাতি তত্ত্বকেই নতুন করে সামনে নিয়ে আসছে।”

জিন্নাহ্-র যে মতবাদ আমরা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দিতে চেয়ে তারা সেটাকেই তো আবার ফিরিয়ে আনতে চাইছে।”

“মুসলিমদের কি দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক বানানোর চেষ্টা হচ্ছে? আর ধর্মীয় নির্যাতনের কথাই যদি বলা হয়, তাহলে মিয়ানমার বা সিরিয়া থেকে নির্যাতিত হয়ে এলেই বা কেন নাগরিকত্ব পাওয়া যাবে না?”, বলছেন মি ওয়াইসি।

পাকিস্তানের আহমদিয়া বা শিয়া হাজারাদের মতো সংখ্যালঘু কিংবা শ্রীলঙ্কায় জাতিগত সংঘাত থেকে পালিয়ে আসা তামিল শরণার্থীরাই বা কেন ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন না, সেই প্রশ্ন তুলছেন বামপন্থীরাও – যারা সরকারের আনা বিলে এদিন দুটি সংশোধনী জমা দিয়েছে।

সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, “কেন শুধুমাত্র তিনটি দেশ – আমাদের মতে সব প্রতিবেশী দেশের ক্ষেত্রেই এই আইন প্রযোজ্য হওয়া উচিত।”

“শ্রীলঙ্কা থেকে আসা লক্ষধিক তামিল গত তিরিশ বছর ধরে তামিলনাডু বা ওড়িশার শরণার্থী শিবিরে দিন কাটাচ্ছেন – মাদ্রাজ হাইকোর্টও তাদের নাগরিকত্ব দিতে বলেছে।”

“ফলে কেন তারা এই সুবিধা পাবেন না?”, প্রশ্ন মি ইয়েচুরির।

“আর দ্বিতীয় যে সংশোধনীটি আমরা দিয়েছি তাতে এই বিলে ধর্মের উল্লেখটাই আমরা মুছে দিতে চেয়েছি।”

শিবসেনার মতো হিন্দুত্ববাদী দলও এদিন মন্তব্য করেছে, এই বিল ভারতের হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে ‘অদৃশ্য দেওয়াল’ তুলে দেবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অবশ্য দাবি করেছেন, এই বিল ভারতে মুসলিমদের কোনও অধিকারই কেড়ে নেবে না – কারণ গোটা বিলে তাদের কথা একবারও উল্লেখই করা হয়নি।

এদিকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে না। বরং তারা শান্তি এবং সম্প্রীতির সাথে বসবাস করছেন। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে এমনটা বলেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

সোমবার ভারতের পার্লামেন্টে দাবি করা হয় যে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন না-থামাটাই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনার অন্যতম কারণ।

এর প্রতিক্রিয়ায় মোমেন বলেন, “আমরা বলতেই পারি যে, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থা এখন খুব ভাল। আগে যারা বিদেশে চলে গিয়েছিলেন, তারাও এখন ফিরে আসছেন।”

ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ তুলে বক্তব্য দিয়ে থাকেন তাহলে তা ঠিক না বলেও মনে করেন মিস্টার মোমেন।

বিল সম্পর্কে মোমেন বলেন, “ভারতেরা কী করলেন সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়, সেটা তারা তারা জানেন। তবে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা খুব শান্তি এবং সম্প্রীতিতে আছেন।”

সোমবার লোকসভায় এ বিল পেশ করতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বাংলাদেশ-সহ তিনটি প্রতিবেশী দেশের সংবিধানকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, এই দেশগুলোর রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বলেই সেখানে অন্য ধর্মের মানুষরা নিপীড়িত হচ্ছেন।

শাহ লোকসভায় বলেন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেওয়ার লক্ষ্যেই বিতর্কিত নাগরিকত্ব বিলটি আনা হয়।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়ার কারণে সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের অভিযোগ ঠিক নয়। এখানে সব ধর্মের মানুষেরাই তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বিনা বাধায় উদযাপন করে থাকে বলেও জানান তিনি।

মিস্টার মোমেন বলেন, “এদেশের নিয়ম হচ্ছে, ধর্ম নিজের নিজের, কিন্তু উৎসব সকলের। আমরা এই নীতিতেই বিশ্বাস করি।”

“আমাদের দেশে নির্যাতনের কোন দৃষ্টান্ত নেই,” তিনি বলেন।

বরং ভারতের সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হয় বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে জানা যায় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এদিকে, কূটনৈতিকভাবে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন ‘শ্রেষ্ঠ সময়’ বা ‘সোনালি অধ্যায়ে’র মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দুই দেশের নেতারা প্রায়ই দাবি করে থাকেন।

অমিত শাহের এমন বক্তব্যের পর বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে কোন ধরণের প্রভাব পড়বে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তর মিস্টার মোমেন বলেন, তিনি আশা করেন যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে।

এই সম্পর্ক নষ্ট করতে ভারতের পক্ষ থেকে কোন ধরণের পদক্ষেপ নেয়া হবে না বলেও আশা প্রকাশ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।

মোমেন বলেন, “বন্ধুপ্রতীম ভারত এমন কিছু করবে না, যা উভয় দেশের জনগণের দুশ্চিন্তার কারণ হয় কিংবা আতঙ্কের সৃষ্টি করে”।

তবে অমিত শাহের বক্তব্যের প্রতিবাদে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হবে কিনা এ বিষয়ে তিনি বলেন, কী সব কারণে অমিত শাহ এগুলো বলেছেন তা উনাকেই জিজ্ঞাসা করতে হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমি এখনো বিলটি দেখিনি, দেখতে হবে”।

এসএইচ-০৫/১০/১৯ ()